সাবেক মন্ত্রীদের গোপন লবিং

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নবম জাতীয় সংসদের যেসব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দশম সংসদের মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি, তারা এক ধরণের স্নায়বিক চাপে ঘুরপাক খাচ্ছেন। ছেড়ে দিয়েছেন দলীয় কাজকর্মে অংশ নেয়া। তাছাড়া দলীয় কার্যালয়েও তারা বসছেন না। সাংবাদিকদের সামনে আসছেন না বা ফোনও রিসিভ করছেন না। কিছুটা হতাশা আর উদভ্রান্ত অবস্থায় তাদের দিন কাটছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

ভাগ্য তাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। কী করবেন, কী হবে এ নিয়ে তাদের খেদ আর দীর্ঘশ্বাসের শেষ নেই। তবে মন্ত্রিত্ব হারিয়ে তারা একেবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। গোপনে দলের উচ্চ পর্যায়ে তারা জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন ফের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার জন্য।

নবম সংসদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইসিটি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।

প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে বাদ পড়েছেন- গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান, পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. মজিবুর রহমান ফকির, শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গত সরকারের আমলে অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিতর্কিত বক্তব্য ও সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদের এমপি মনোনয়ন নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরই অংশ হিসেবে গত সরকারের মেয়াদের চারমাস আগেই তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে শুধু মন্ত্রিসভা থেকেই বাদ পড়েননি, দলীয় মনোনয়নও দেয়া হয়নি সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, আইসিটি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়াকে।

জানা গেছে, গত নবম জাতীয় সংসদে সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বক্তব্য, দলীয় কাজকর্মে অমনোযোগ ও দলীয় শৃঙ্খলা বহির্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না রাখার মতোও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।

এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তিনি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম ও ঈদের ছুটিতে বাড়িতে তালা দেয়ার কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়েন। এরপর তাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলে দশম সংসদের মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি তাকে।

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বির্তকিত কর্মকাণ্ডর মাধ্যমে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থান ফেলেন। সাভারের রানা প্লাজার ভবন ধসে পড়ার পর ‘ভবন ধরে নাড়াচাড়ার’ তত্ত্ব দিয়েছিলেন। সাবেক এই আমলা দক্ষতার সঙ্গেই নিজের দায়িত্ব পালন করবেন, এ প্রত্যাশা ছিল সরকারের উর্ধ্বতন মহলের। কিন্তু তিনিও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে বারবার আল্টিমেটাম, সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্যামেরার সামনেই সাগর-রুনি সম্পর্কে অপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন সরকার ও আওয়ামী লীগকে।

এছাড়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ছিলেন মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি গত পাঁচ বছরে বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও সমুদ্রসীমার মামলার রায় ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেননি। তিনি পাঁচ বছরে ৭৬ বার বিদেশ ভ্রমন করেছেন বিভিন্ন ইস্যুতে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্ম্পকের টানাপোড়ন তার কারণেই হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। তার কারণেই সাতক্ষীরা মূলত জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে বলেও দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি গত পাঁচ বছরে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডেও ভূমিকা ছিল না তার।

গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ফ্ল্যাট ও প্লট বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। তাছাড়া নামে-বেনামে সরকারি বাড়ি কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছেন বলেও দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর বিরুদ্ধে বাচালতা (সর্বশেষ কাদের মোল্লার ফাঁসির সময় বলে দেয়া), ক্ষমতার অপব্যবহার ও নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের বিরুদ্ধে রয়েছে তার এপিএসের রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ।

স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের বিরুদ্ধে সরকারি টাকা এদিক-সেদিক করার অভিযোগ রয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে খাদ্য অধিদপ্তরে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ড. হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে স্ত্রীর নামে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে ফারুক খান, ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামসহ কয়েকজন নেতা ক্ষমতার পালাবদলে স্বাভাবিক নিয়মেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। তবে ফারুক খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না রাখার।

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার দক্ষতার অভাবেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে শিল্পখাতে সাফল্য না আসার ব্যর্থতা দিলীপ বড়ুয়ার। এমনকি তার বিরুদ্ধে নিজ ও পরিবারের সদস্যের নামেও বেশ কয়েকটি প্লট নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার এবার দলীয় মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।

ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে দক্ষতার অভাবেই মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট্র সূত্রে জানা গেছে।

তবে এ থেকে বাদ পড়েননি দশম সংসদে দলের টিকিট পেয়েও নির্বাচিত না হওয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ। তিনি ইদানিং সাংবাদিকদের সঙ্গেও কম কথা বলছেন। এর আগে যাকে ফোন দিলেই তাকে পাওয়া যেত।

অন্যদিকে ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের ফোন ধরা বাদ দিয়েছেন। ডা. দীপু মনি ব্যস্ততা দেখিয়ে সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন। জাহাঙ্গীর কবির নানককে এখন আর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কিংবা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলতে চাচ্ছেন না।

ড. আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল মান্নান খানকে দলীয় কার্যালয়ে দেখা গেলেও তারা কথা বলতে চাচ্ছেন না।

এদিকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শামসুল হক টুক, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ও অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের দেখাই মিলছে না। সাবেক এই মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরদের পর্দার আড়ালে চলে যাওয়ার পেছনে ‘বড় টেনশন’ কাজ করছে বলে দলের একাধিক সূত্র দাবি করেছে। তবে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে আবারও ফিরে আসতে চান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, দলের শীর্ষ নেতাদের দরজায় কড়া নাড়ছেন বিভিন্নভাবে। তাদের এখন একটাই টার্গেট, যে কয়টি মন্ত্রণালয় এখনও খালি আছে, সেগুলোর একটি বগলদাবা করা।

এ বিষয়ে জানতে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে বারবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। সভাপতি মন্ডলীর সদস্য আব্দুল লতিফ বিশ্বাসও ফোন রিসিভ করেননি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি আরেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদকেও।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫