স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাশিয়ার একটি ‘ওয়াইম্যাক্স’ কোম্পানি দেশে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স পেয়েও এখনও কাজ শুরু করেনি। তাদের পরিকল্পনা এ দেশে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের। শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই কোম্পানি তাদের কার্যক্রম শুরু করছে না। পুরো পরিস্থিতি কোম্পানির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে এ মুুুহূর্তে বিনিয়োগের কার্যক্রম শুরুকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
একইভাবে জার্মানির একটি কোম্পানি বিমান লিজ ও সফটওয়্যার তৈরি করে দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ বিমানের দরপত্রে অংশ নিয়ে কার্যাদেশ পায়। বিমান লিজের ভাড়া হিসেবে বছরে ৬৬ লাখ মার্কিন ডলার দেয়ার কথা বাংলাদেশকে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই কোম্পানি কার্যাদেশ পেয়েও পিছিয়ে গেছে। একাধিকবার তাগিদপত্র দেয়ার পরও কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মিলছে না। এই সময়টাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য ওই জার্মান কোম্পানি ঝুঁকি মনে করছে। দেশের গত তিন মাসের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এভাবেই আঘাত হেনেছে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর। একই সঙ্গে তা চরমভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের বেলায়ও। বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে বিগত তিন মাসে কমপক্ষে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হয়েছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি ঠিক থাকলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে দেশ আবার নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দেশের অর্থনৈতিক গতি পুনরুদ্ধারে এ সময়ের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে আনা, বিনিয়োগের ধারাকে গতিশীল করা, বিনিয়োগ নষ্টের কারণে অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়ছে তা পর্যালোচনা করে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সম্ভাব্য প্রণোদনা দিয়ে তাদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা।
বাংলাদেশ ফরেন ইনভেস্টমেন্ট চেম্বারের সভাপতি রূপালী চৌধুরীর মতে, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখনও বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্য করে বিনিয়োগকারীদের নতুনভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগে কতখানি আঘাত হেনেছে বিনিয়োগের সর্বশেষ তথ্য থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। গত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসে মোট বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১০ কোটি মার্কিন ডলারের। অথচ আগের বছরে একই সময়কালে ১২৫ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ এসেছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গত তিন মাসে আগের বছরের তুলনায় ১১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ কম এসেছে।
এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের অতিরিক্ত সচিব নাবাস চন্দ্র মণ্ডল জানান, গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিবেশ অবনতির কারণে শুধু বিনিয়োগ নয়, সব ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপরও যে বিনিয়োগ আসছে, পরিস্থিতি ভালো হলে আরও বেশি আসত। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দেশের পরিস্থিতি দেখে এখন কি ভাবছেন সে সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ রয়েছে তাদের, কারণ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আজ পর্যন্ত কোনো কোম্পানি লোকসান করেনি।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গেল ডিসেম্বরে দেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব জমা হয়েছে ৪৯ কোটি ডলারের। নভেম্বরে ৬৮ কোটি ও অক্টোবরে ৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগের প্রস্তাব পড়েছে। বিনিয়োগের তথ্য অনুযায়ী এটি গত বছরের তুলনায় বেশ কম। দেশী বিনিয়োগ বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৫ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ১২ হাজার ২৬৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এছাড়া গত ১৩ মাসে ব্যাংকগুলোতে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি আমানত বেড়েছে। গত অক্টোবরের শেষে ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১১৯ কোটি টাকা। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট একে আজাদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি শিল্পখাতে ১৮ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। সেখানে ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। শিল্প উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগ না করার আরও দুটি মুখ্য কারণ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের বিনিয়োগ কমলে প্রবৃদ্ধি কমবে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমলে সামগ্রিক বিনিয়োগের ওপর প্রভাব পড়বে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বেকারত্ব বাড়বে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশৃংখল পরিবেশ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন। দেশ ও জাতির কল্যাণের প্রশ্নে প্রধান দু’দলের মধ্যে সমঝোতা দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক বড় দু’দল থেকে যে ধরনের ম্যাসেজ আসছে তাতে সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। অনিবার্যভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপর।
রাজনৈতিক অঙ্গনের খরা পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে এলেও বিনিয়োগের খরা কাটছে না। নতুন সরকারের যাত্রার সূচনায় বিনিয়োগের তথ্য অনুযায়ী নতুন অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন কোনো চমক থাকছে না। গতানুগতিকভাবেই চলছে বিনিয়োগ আনার কার্যক্রম।
বিদেশী বিনিয়োগ আনতে বিশ্বের তিনটি দেশে তিনটি রোড শো করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন কোন দেশে এ রোড শোর আয়োজন হচ্ছে তা এখনও স্থির করা হয়নি। বিনিয়োগকারীরা এ দেশের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে। মূলত বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এসব সংগঠন বৈঠকে মিলিত হতেন। এসব কার্যক্রমও এখন বন্ধ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ বলেন, বিনিয়োগকারীরা স্থায়ী সমাধান চায়। এখন বিনিয়োগ করার পর দু’মাস পরে আবার পরিবেশ অশান্ত হবে এটি তারা চায় না। গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা হোঁচট খেয়েছে। তারপরও আমরা বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছি। মিয়ানমার থেকে বিনিয়োগ আসবে। চীনে একটি বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছি। পরিবেশ আপাতত ঠিক হয়েছে। আশা করছি আবারও বিনিয়োগ আসতে শুরু করবে। সামনে উপজেলা নির্বাচন হবে। সবাই নির্বাচনমুখী হলে পরিবেশ আরও ভালো হবে। বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থা ফিরে আসবে। আমরা আশা করব, দেশে একটা স্থায়ী স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংবাদ মাধ্যমকে জানান, গত তিন মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে। এফডিআই প্রবাহে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে আগামীতে এফডিআই বৃদ্ধি পাবে। হত্যা-খুন বন্ধ হলে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি ঠিক থাকলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা অথবা আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি এ সবকিছুই নির্ভর করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিরোধী দলের সহযোগিতার ওপর। সেক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই অগ্রণী হওয়া বাঞ্ছনীয়।