স্টাফ রিপোর্টার ॥ গতকাল প্রথম পর্বের তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মুসল্লি এতে অংশ নিয়েছেন। বুধবার থেকেই ইজতেমাস্থলে আসতে থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে কহর দরিয়ার তীরে অনুষ্ঠিত ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হবে ২৬শে জানুয়ারি। চারদিন বিরতি দিয়ে ৩১শে জানুয়ারি শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। তুরাগ নদীর তীরে ১৬১ একর এলাকা জুড়ে আয়োজিত ইজতেমায় বিশ্বের শতাধিক দেশ থেকে এসেছেন ২৫/৩০ হাজার বিদেশী মেহমান। এর মধ্যে প্রথম পর্বে অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার বিদেশী মেহমান। তাদের খেদমতে সর্বদা কাজ করছেন তাবলীগ জামায়াতের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক।
প্রথম দিনে দেশের সর্ব বৃহৎ জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা জোবায়ের হাসান জামাতের ইমামতি করেন। ইজতেমার মাঠে জুমার জামাতে অংশ নিতে সকাল থেকেই আশপাশের এলাকা থেকে ইজতেমা অভিমুখী ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা আসতে থাকেন। বেলা ১টায় মূল ময়দান ছাড়িয়ে পূর্ব পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জুমার জামাত শেষে ইজতেমা ময়দানের চারদিকে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত মুসল্লিরা নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা হন। এ সময় মুসল্লিদের পদভারে পুরো এলাকা ধুলোবালিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
গতকাল বাদ ফজর তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি পাকিস্তানের মাওলানা ইহসানের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্ব তিন দিনের ইজতেমার সূচনা হয়। প্রথম পর্ব প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিপুলসংখ্যক বিদেশী মুসল্লিসহ দেশের ৩২টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নিয়েছেন। রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের প্রথম পর্বের ইজতেমা সমাপ্ত হবে। গতকাল তাবলীগের ৬ উসুল সম্পর্কিত বিষয়ে বাদ আসর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জুবায়েরুল হাসান এবং বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা’দ।
সাধারণ মুসল্লিদের রান্না-বান্নার স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব না হলেও ময়দানের পশ্চিম-উত্তর কোনায় টিন শেডের উন্নত আবাসনে বিদেশী মেহমানদের রান্নার জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ এবং আধুনিক সুবিধা রয়েছে। এ বছর ময়দানে জেলাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থানের জন্য পুরো ময়দানকে প্রথম পর্বে ৪০টি খিত্তায় এবং দ্বিতীয় দফায় ৩৮টি খিত্তায় ভাগ করা হয়। জেলাওয়ারি জামাতবদ্ধ মুসল্লিরা এসব নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন।
বিভিন্ন সংগঠনের পানি সরবরাহ: ইজতেমা ময়দানে আসা-যাওয়ার পথে মুসল্লিদের পানি পিপাসা নিবারণের জন্য সকালে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করে বিভিন্ন সংগঠন।
সুযোগ সুবিধা: ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের কাজে আসা মুসল্লিদের বয়ান শোনার জন্য ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি এলাকায় তৈরি করা হয়েছে বয়ান মঞ্চ। একই পাশে আরও রয়েছে নামাজ পড়ার মিম্বার, তাশকিলের কামরা, জামায়াত কক্ষ ও মোকাব্বির মঞ্চ। এ ছাড়া বয়ান শোনার জন্য মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি রোদ ও কুয়াশা থাকাতে খুঁটির ওপর তাঁবু ও অস্থায়ী ছাতা নির্মাণ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা:নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আসা মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইজতেমা মাঠের প্রবেশদ্বারে ৫ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর প্রতিটি স্তরেই রয়েছেন একজন করে সহকারী পুলিশ কমিশনার। গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন জানান, প্রথম পর্বের ইজতেমার নিরাপত্তায় ১২ হাজার পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকরাও রয়েছেন। বোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য রয়েছেন বোম ডিসপোজাল স্কোয়াড।
র্যাব-১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আহসানুল কবির জানান, ৪টি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছে র্যাবের সদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকছে ৮টি ওয়াচ টাওয়ার। সেই সঙ্গে নৌ-টহল ও চেকপোস্ট রয়েছে। এ ছাড়া ২টি হেলিকল্পটারে এয়ার পেট্রলিং চলছে।
খাবারের মান: দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মের টানে আসা মুসল্লিদের খাবারের সঠিক মান নিশ্চিত করতে রয়েছেন তাবলীগে জামাতের শীর্ষ মুরব্বিরা। এরই মধ্যে ইজতেমা মাঠ ও এর আশপাশে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক খাবার হোটেল। হোটেলগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ১১টি টিম। প্রত্যেকটির নেতৃত্বে রয়েছেন একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট। বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জন মিলনায়তনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. খন্দকর মো. সিফাতুল্লাহ স্থানীয় খাবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। তাতে বিশেষভাবে সকল হোটেল ও দোকান মালিকদের ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের সেবার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে বলা হয়। ব্যতিক্রম হলে কঠোর শাস্তির কথাও জানান তিনি।
টয়লেট: টয়লেটের সঙ্কট নিরসনে এবার অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ৪ হাজার টয়লেট। একই সঙ্গে রয়েছে গোসলখানা। যেখানে একসঙ্গে অন্তত ৪ হাজার মুসল্লি তাদের প্রয়োজন সারতে পারবেন।
বিদেশী মেহমানদের বিশেষ আপ্যায়ন: বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আসা হাজারো মেহমানের জন্য মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোনে নির্মাণ করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আপ্যায়ন ব্যবস্থা। ইংলিশ ও আরাবিদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু। যেখানে টেলিফোন ইন্টারনেট থেকে শুরু করে রয়েছে সকল ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা। খাবারের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। সকালের নাস্তায় রয়েছে স্যুপ, ডিম রুটির পাশাপাশি দুপুর ও রাতের জন্য বিরিয়ানি। এসব রান্নার জন্য ২ শতাধিক জিম্মাদার রয়েছে বলে জানান মেহমান খানার জিম্মাদার মো. আজিজুল হক।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প: বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। হামদর্দ বোর্ড অব স্ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, ওয়াকফ প্রশাসক বজলুল হক বিশ্বাস, র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ মোতোওয়ালি ড. হাকিম মো. ইউসুফ হারুন ভূঁইয়া ও হামদর্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুবুল আলম চৌধুরী (অব.) প্রমুখ। । এ ছাড়াও ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্প এলাকায় জনকল্যাণ ফার্মা, রেনাটা, বিএমএ, র্যাব, গাজীপুর সিটিকর্পরেশন, টঙ্গী প্রেস ক্লাব, টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইসলামী ফাউন্ডেশন, ইস্পাহানী ইসলামীয়া চক্ষু ইন্সটিটিউট, যমুনা ব্যাংক, এপেক্স বাংলাদেশ, কিউআইএস মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনসহ প্রায় ৩৬টি সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেছে।
স্বাস্থ্যসেবা: স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক ডা. সিফায়েত উলাহ বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে সকল প্রস্তুতি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে আরও ৫০টি শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। হাসপাতালে একটি নিজস্ব কন্ট্রোল রুম ছাড়াও কার্ডিয়াক, বার্ন, অ্যাজমা, ট্রমাসহ বিভিন্ন ইউনিট খোলা হয়েছে। এ ছাড়াও টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের উদ্যোগে মুন্নুগেট, বাটা গেট ও হোন্ডা রোডে মুসল্লিদের তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার জন্য ৩টি মেডিকেল সেন্টার খোলা হয়েছে। মুসল্লিদের সেবা প্রদানের জন্য টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল সেন্টারগুলোতে ১২টি এ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইজতেমা এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ৩০টির মতো ফ্রি মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। হোটেলে খাবারের মান ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেটসহ সেনিটেশন টিম কাজ করছে।
নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: ইজতেমার মাঠে সকল প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। যার মধ্যে নিউ মুন্নু ফাইন কটন মিল ক্যাম্পাসে রয়েছে জেলা প্রশাসন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশেন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), র্যাব, পুলিশ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম জানান, এবারের ইজতেমায় অন্য বারের চেয়ে মুসল্লিদের উপস্থিতি অনেক বেশি। তাই প্রতিবারের মতো এবারও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন ১১ জন ম্যাজিস্ট্রেট। সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষের টেলিফোন নং- ৯৮১৩৪০১।
বয়ান: গতকাল বাদ ফজর আম বয়ান করেছেন- বাংলাদেশের মাওলানা নুরুল হক, পাকিস্তানের মাওলানা এহসান ও ভারতের মাওলানা আহমদ লাকসহ বিশ্ব তাবলীগ জামাতের মুরব্বিরা। ইজতেমা মাঠের কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা তাবলীগের শীর্ষ মুরব্বি গিয়াসউদ্দীন জানান, এখানে সব কাজ করা হয় মাশআরার (পরামর্শ) মাধ্যমে।
২ মুসল্লির মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমায় এসে হাজী আবদুল মজিদ (৬৫) ও ওমর আলী (৪৮) নামে দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে তাদের মৃত্যু হয়। গতকাল সকালে ইজতেমা ময়দানের লাশ ঘরের জিম্মাদার মো. আদম আলী জানান, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে টয়লেটে যাওয়ার পথে হঠাৎ পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান আবদুল মজিদ। এর আধা ঘণ্টা আগে নিজ খিত্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ওমর আলী। অসুস্থ দুজনকে তাৎক্ষণিক টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেয়ার পথে তাদের মৃত্যু হয়। তিনি আরও জানান, হাজী আবদুল মজিদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার মধ্য সেতুয়ালী এলাকায় এবং ওমর আলীর বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী মানবজমিনকে জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওমর আলী এবং বার্ধক্যজনিত কারণে আবদুল মজিদের মৃত্যু হয়েছে।
যৌতুকবিহীন বিয়ে: শনিবার বাদ আছর বিশ্ব ইজতেমা মাঠের বয়ান মঞ্চে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করা হবে। হযরত ফাতেমা (রা.) ও হযরত আলীর (রা.) বিয়ের দেনমোহর অনুসারে বিনা যৌতুকে সম্পন্ন হবে বিয়ে। বর-এর অভিভাবক এবং কনের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে এই সব বিয়ে পড়ানো হবে। বিয়ের পর রেওয়াজ অনুযায়ী উপস্থিত দম্পতিদের স্বজন ও মুসল্লিদের মধ্যে খোরমা খেজুর বিতরণের কথা রয়েছে।