স্টাফ রিপোর্টার ॥ বহু তেলেসমাতি দেখালেন বাংলাদেশের রাজনীতির মুকুটহীন রাজা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। স্বৈরাচার বলে মানুষ যত্রতত্র তাকে নিয়ে ঘৃণা বিলি করলেও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাছে তিনি যে মহামূল্যবান রতœ তা দুই নেত্রীকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত।
দীর্ঘ একমাস তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও নার্সদের কোমল পরিচর্যায় ছিলেন। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে শপথের দিনটিতে হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে খাড়া হলেন। শুধু তা-ই নয় রোববার একজন পূর্ণমন্ত্রী এবং দুই জন প্রতিমন্ত্রীকে পকেটস্থ করে তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেন।
প্রাপ্তিযোগ আরো আছে: স্ত্রী সাবেক ফার্স্ট লেডি হয়েছেন দশম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা আর নিজে হয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তিনি নাকি একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন। তার মানে স্বামী-স্ত্রী মিলে বলতে গেলে পাঁচটি মন্ত্রী বাগিয়েছেন তিনি। বুঝা যাচ্ছে, তিনি শুধু দর্শক হাসানো নাটক করেন না তার নাটক শেষে সিরিয়াস প্রাপ্তিযোগও থাকে।
শপথের পরদিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরাটা অনেকে অবশ্য হাস্যকর বলে মনে করছেন। তারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিষেশ দূত হওয়ার মধ্যদিয়ে এতদিনের টানটান উত্তেজনার ধারাবাহিক নাটকের যবনিকাপাত হলো।
অবশ্য জাতীয় পার্টির নেতারা চেয়ারম্যানের হয়ে মিনমিন করে আত্মপক্ষ সমর্থন করছেন। তারা বলছেন, সরকার অসুবিধায় পড়ে এরশাদকে ব্যবহার করেছে। তাকে প্রভাবিত করেই বিভিন্ন কাজ করাতে বাধ্য করা হয়েছে।
কিন্তু রাজনীতিক ও রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা একটু চাঁছাছোলা কথা বলছেন এই সাবেক সেনা শাসকের বিরুদ্ধে। এরশাদ বাধ্য হয়ে এতোকিছু করেছেন তারা এটা মানতে নারাজ। তাদের কথা হলো- নির্বাচন বর্জন থেকে শুরু করে যা কিছু ঘটেছে তা নাটক ছাড়া কিছুই নয়। এরশাদের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোটায়। তাই তিনি নষ্ট রাজনীতির ফায়দা লুটেছেন মাত্র।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘উনার (এরশাদ) সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তিনি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তবে এখন তিনি যেসব কাজ করছে তা হাস্যকর। তিনি নাটকের পরও নাটক করেছেন।’
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এটাকে শাসক দলের একটি তামাশার অংশ বলে বর্ণনা করতে চান। তার ভাষায়- এরশাদকে নিয়েও তারা তামাশা করছে। তিনি এতোদিন রাজনীতি কেনা বেচা করেছেন। এখন নিজেকেই বিক্রি করে দিলেন। এতদিন যে নাটক দেখলাম এর নেপথ্যে ছিল আসলে সরকার। আর এতে অভিনয় করেছেন এরশাদ।
কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই সাবেক রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত। এই মুহূর্তে তিনি তাকে নিয়ে মন্তব্য করতেই রাজি হলেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে পরে মন্তব্য করবেন বলে জানালেন তিনি।
এরশাদের কাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষও ক্ষিপ্ত। তারা মনে করেন, মানুষ বয়স হলে উল্টাপাল্টা কথা বলেন। কিন্তু এরশাদ একটু বেশি মাত্রায় বলেছেন। দোষটা তার বয়সের ওপরই চাপাতে চায় সাধারণ নিরীহ মানুষ।
এরশাদ এতদিন শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছেন, এখন আবার তার বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেলেন। তার এমন ভূমিকাটাকে কীভাবে দেখবেন? ব্যবসায়ী মীর রহমত উল্লাহ জবাবে বলেন, ‘এরশাদ সকালে এক কথা বলেন, তো বিকালে আরেক কথা বলেন। তাই তার দ্বারা সব কিছু সম্ভব। এই মানুষ ৯ বছর রাষ্ট্রপতি কীভাবে ছিলেন, এটা আমার বোধগম্য নয়।’
তবে বিরোধী দলে থেকে আবার সরকারের অংশীদার হওয়াতে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কারণ দশম জাতীয় সংসদেও আর কোনো কার্যকর বিরোধী দল দেখার সৌভাগ্য হবে না। চাকরিজীবী ফয়সাল মাহমুদ বলেন, ‘এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন। সরকারের সমালোচনার আর কোনো লোক থাকলো না। এটা সত্যি হতাশাজনক। এরশাদও শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নৌকায় আবারও গা ভাসালেন।’
জাতীয় পার্টির নেতারা আবার পুরো বিষয়টি সরকারের ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছে। তাদের চাপে পড়েই এরশাদ বারবার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন। তা না হলে তিনি এমন লোক নন!
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, ‘আপনারা সব বোঝেন, শপথের একদিন পর তিনি বাসায় ফিরে এলেন। এতে সব কিছু পরিষ্কার হওয়াটা স্বাভাবিক বলে মনে করি। আমি যদি অসুস্থ হই, তাহলে আমি নিজেই হাসপাতালে যাব। না হয় পরিবারের লোকজন নিয়ে যাবে। র্যাব-পুলিশের প্রয়োজন হবে না।’
জাতীয় পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লিংকন বলেন, ‘সরকার এতটাই অসুবিাধায় পড়েছিল যে, তার অতীতের সব গুনা মাফ করে তাকে পুরস্কৃত করছে।’ শেখ হাসিনাকে অতি দয়ালু বলেও মন্তব্য করেন জাপার এ নেতা। অবশ্য তার কণ্ঠে শ্লেষ স্পষ্ট ছিল।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাটকের উপক্রমনিকা থেকে যবনিকা পর্যন্ত ধারাবাহিক দৃশ্য বর্ণনা করলে যেমনটি দাঁড়ায়:
গত ১৮ নভেম্বর মহাজোট ছেড়ে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেন। জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করবে বলে ঘোষণা দেন। এর কয়েকদিন পর ৩ ডিসেম্বর আবার মত পাল্টিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
এসময় এরশাদ অভিযোগ ছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তিনি সব দলের অংশগ্রহণের দাবি জানান। এর পর পরই জাতীয় পার্টির সব নেতাকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়া মন্ত্রীদেরও মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। নিজেও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন যদিও সেগুলো ত্রুটির অজুহাতে তা গৃহিত হয়নি। যথারীতি এরশাদ এমপি হয়েছেন।
১২ ডিসেম্বর অসুস্থ বলে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হয়। যদিও সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এরশাদ আটক হননি। সেখানে থেকেই মাঝে মাঝে গলফ খেলতেও গেছেন বলে নিন্দুকরা বলে। ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে হাসপাতালে ফেরেন। দীর্ঘ একমাস পর একই দিন রাতে বনানীর বাসায় ফেরেন।
নির্বাচনে অংশ না নেয়ার জন্য কমিশনে তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা নাটকীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়নি। পরে তিনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে একটি আসনে বিজয় লাভ করেন এবং একটিতে পরাজিত হন। তার দলের অন্য বিজয়ীরা গত বৃহস্পতিবার শপথ নিলেও তিনি অজ্ঞাত কারণে শপথ নেননি। এসময় ছোটভাই জিএম কাদের ও দলের জন্য মন্ত্রী দেয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি চলছিল বলে শুনা যায়।
এরপর গুঞ্জন ওঠে তিনি শপথ নেবেন শুক্রবার। তবে শুক্রবারও শপথ নেননি। অবশেষে শনিবার সংসদ সদস্য হিসেব শপথ নেন এরশাদ। শপথ শেষে তাকে পুনরায় সিএমএইচ নেয়া হয়। সংসদে তিনি এক কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন, ‘রংপুর বাসী যেহেতু ভোট দিয়েছেন তাই শপথ নিলাম।’
পর দিন রোববার তাকে মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো হয় তাকে। তিনি সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সিএমএইচ থেকে বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। পরে বনানীর বাসায় ফেরেন।
‘এরশাদ সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবেন’ এমন গুঞ্জন শেষ পর্যন্ত সত্য করে বাসায় ফিরলেন এরশাদ। তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হলো।