বাংলাভূমি২৪ডেস্ক ॥ চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সীমান্তবর্তী মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় স্থাপিত দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের আট বছর পর ফের চালু হচ্ছে।
প্রকল্পটিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকারপর আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। নির্মাণের পর কারিগরি ক্রটি ও অব্যবস্থাপনার কারণে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর পর্যন্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে আবার প্রকল্পটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকল্পটিকে কারিগরি ক্রটিমুক্তকরণ এবং সংস্কারের কাজ চলছে পুরোদমে।
জানা গেছে, সোনাগাজী উপজেলার সোনাপুর গ্রামে ৯০০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ একর ভূমির ওপর ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ভারতের নেবুলা টেকনো সল্যুশনস কোম্পানী লিমিটেড প্রকল্পের কাজ পায়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) ২০০৪-০৫ অর্থবছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি বায়ু শক্তি চালিত বিদ্যুৎ ইউনিট স্থাপন করে।
ভারতের নেবুলা টেকনো সল্যুশনস কোম্পানী লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ার, জেনারেটর, কন্ট্রোল প্যানেল, সাব স্টেশন, ম্যাচিংগিয়ার ইলিমেন্টসহ প্রকল্পের মূল যন্ত্রাংশগুলো আনা হয় ভারত থেকে। প্রকল্পে ১৪০ ফুট উঁচু চারটি টাওয়ার নির্মাণ করা হয়। এক টাওয়ার থেকে অন্যটির দূরত্ব ৩০০ মিটার। প্রতি ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ারের মাথায় দেড়টন ওজনের তিনটি করে পাখা লাগানো হয়। ৪টি কন্ট্রোলিং ট্রান্সফর্মার বসানো হয়। আশা করা হয়েছিল ৪টি টাওয়ার থেকে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। যার প্রতি ইউনিট মূল্য হবে মাত্র ২ টাকা।
২০০৫ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন একটি সংসদীয় কমিটি বিদ্যুৎ প্রকল্পটি আবদুল আলিমের নেতৃত্বে ১০ সদস্য বিশিষ্ট দলের পরিদর্শনের পর ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনও শুরু হয় এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সঙ্গে চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুৎ সমিতির কাছে সরবরাহ করা হয় এবং সমিতি ওই বিদ্যুতের বিল পরিশোধও করে। কিছুদিন বিদ্যুৎ প্রকল্পটি চালু থাকারপর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফের চালু করার চেষ্টা করলেও সাথে সাথে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিত। প্রকল্পটিতে কর্তৃপক্ষের নজর না থাকায় একটি টাওয়ারের ক্যাপাসিটর বক্স থেকে রাতের আঁধারে প্রায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করলেও চুরি হওয়া মূল্যবান মালামালের কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। প্রকল্প পরিচালনায় স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে ১১/০.৪ কেভি লাইনের একটি সংযোগ টানার পাশাপাশি টু-ওয়ে মিটারও স্থাপন করা হয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনাবেচার জন্য। কিন্তু ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে কিছুদিন চলার পর বাতাসের গতিবেগ কম হওয়ায় উৎপাদন কম হবে এবং এতে লোকসান হবে, এ আশঙ্কায় বিদ্যুৎ প্রকল্পটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাতাসে বিশাল আকৃতির পাখা ঘোরার মাধ্যমে ৯০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারের। কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে, চীনের নিম্মমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার আর ভারতের অদক্ষ ঠিকাদারের কারণে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি সাফল্যের মুখ দেখলেও তা দীর্ঘ হয়ে উঠেনি।
এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বর্তমানে ফের পিডিবি কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি কারিগরি ত্রুটিমুক্ত করে চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ভারতের প্যান এশিয়া নামে অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্যান এশিয়া নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ প্রকল্পটির মেরামত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শীঘ্রই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি চালু করার জন্য প্রকল্পের প্রবেশপথটি পাকাকরণ করা হয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে পূর্বের তুলনায় নতুন আঙ্গিকে সাজানো হচ্ছে প্রকল্পটিকে।
ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্পটির প্রতিটি টাওয়ারের পাশে দেখভালের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থাপূর্বক কন্ট্রোল রুম তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে কবে নাগাদ প্রকল্পটির চলমান কাজ শেষ হবে এবং পূণরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে তা প্রকল্পে কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেননি।
প্যান এশিয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন জানান, কিছুদিনের মধ্যে প্রকল্পটির মেরামত ও সংস্কার কাজ শেষে পূণরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
তিনি আরো জানান, প্রতিটি টাওয়ারের পাশে একটি করে কন্ট্রোল রুম এবং দেখাশোনার জন্য কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টাওয়ারের রং করার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সাব স্টেশনের ট্রান্সফরমারগুলো মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। নতুন করে মেরামতের জন্য কি পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে তা তিনি জানাতে পারেননি।
ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সভাপতি আবদুল মোতালেব জানান, বিদ্যুৎ প্রকল্পটি চালু অবস্থায় সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ড হয় ২৫০ কিলোওয়াট। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখার জন্য প্রকল্প এলাকায় কোনো সীমানাপ্রাচীর না থাকায় অরক্ষিত হয়ে পড়বে। বর্তমানে প্রকল্পের চলমান কাজ শেষ হলে ফের বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে তা বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।