মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়নে বাধা দিচ্ছেন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ জীপুরের শ্রীপুরের ওয়েল টেক্স নামের পোশাক কারখানার ফটকে অপারেটর মজিবুর রহমানের একটি ছবি ঝুলিয়ে দেয় মালিকপক্ষ। তিনি যেন কারখানায় প্রবেশ করতে না পারেন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। একই কারখানার লিপি আক্তারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে দস্তখত নিয়ে রাখে মালিকপক্ষ।

পোশাকশ্রমিক মজিবুর ও লিপির দোষ হচ্ছে, তাঁরা ওয়েল টেক্স কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে চেয়েছিলেন। একই অভিযোগে ৭৮ জন শ্রমিককে মৌখিকভাবে চাকরিচ্যুত করে কারখানায় ঢুকতে দিচ্ছে না বেসিক অ্যাপারেলস। নারায়ণগঞ্জের সোয়েব নিট কম্পোজিটের ৪৪ ও রেডিক্যাল ডিজাইনের ২৫ এবং গাজীপুরের ডরিন ওয়াশিং প্ল্যান্টের ১৪ জন শ্রমিকেরও একই অবস্থা। অন্যদিকে ইউনিয়ন করার অভিযোগে নয় শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ।

এভাবেই দেশের তৈরি পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমসংঘ করতে মালিকপক্ষের নির্যাতন ও চাকরিচ্যুতির খড়গের মুখে পড়ছেন শ্রমিকেরা। অধিকাংশ পোশাকমালিকই চাচ্ছেন না, তাঁর কারখানায় ইউনিয়ন হোক। আর সে জন্যই শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করলে সেটি ঠেকাতে নানা পন্থা ও কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন তাঁরা।

সম্প্রতি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সাতটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে গিয়ে শ্রমিকেরা নির্যাতন, চাকরিচ্যুতি, মামলাসহ বিভিন্ন অনিয়ম হচ্ছে—এমন অভিযোগ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি ই-মেইল করেছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে।

এ ছাড়া গত ১৯ নভেম্বর জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন (এনজিডব্লিউএফ) শ্রম মন্ত্রণালয়েও একটি লিখিত দিয়েছে। এতে অভিযোগ করা হয়, নিবন্ধন পাওয়া পাঁচটি ও নিবন্ধনের জন্য জমা দেওয়া দুটি কারখানার মোট ১৮১ জন ইউনিয়নের নেতা ও সদস্য শ্রমিককে বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুতি করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাগজপত্রে এই শ্রমিকের স্বাক্ষর নিয়েছে মালিকপক্ষ।

এনজিডব্লিউএফের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, ‘অভিযোগ দেওয়ার পর এক মাস পার হয়ে গেছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযোগ সঠিক।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার সম্প্রতি বলেন, ইউনিয়ন করতে গেলেই শ্রমিকেরা সমস্যায় পড়ছেন। কেউ কেউ হামলার শিকারও হচ্ছেন। চাকরিচ্যুতি ঘটনা তো অহরহ। আসলে শ্রমিকদের ওপর একধরনের অদৃশ্য চাপ রয়েই গেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে চাপ দিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মহল। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর এটি আবার আলোচনায় আসে। এদিকে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে আমেরিকা গত জুনে বাংলাদেশকে দেওয়া রূপরেখায় কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নতির পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে জোর দেয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইউনিয়ন হলে শ্রমিকদের সমস্যা, চাহিদা ও দাবি নিয়ে দর-কষাকষি হবে। এতে একচেটিয়াভাবে কারখানা আর চালানো যাবে না। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের সব দিক দিয়ে বঞ্চিত করার প্রবণতা থেকেই মালিকেরা ইউনিয়ন করতে বাধা দেন। অনেক সময় সর্বশক্তি নিয়োগ করছেন।’

যেভাবে বাধা তৈরি: প্রতিবেদনের শুরুতে মজিবুর রহমান ও লিপি আক্তারের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা দুজন ওয়েল টেক্স কারখানায় অপারেটর পদে কাজ করেন। সাত-আট মাস আগে ইউনিয়ন করার জন্য কারখানার এক হাজার ২০০ শ্রমিকের মধ্যে ৫৭০ জনের স্বাক্ষর নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম পরিচালকের কাছে আবেদন করেন।

তবে প্রথম দফায় মালিকপক্ষের তৎপরতায় প্রক্রিয়াটি ভেস্তে যায়। পরে আবার ৩৫ জন শ্রমিকের স্বাক্ষর নিয়ে আবেদন করেন মজিবুর ও লিপি। এবার জাতীয় গামেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম হস্তক্ষেপ করলে গত ২৭ অক্টোবর নিবন্ধন পায় কারখানা ইউনিয়নটি। অবশ্য এর খেসারত হিসেবে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুরসহ তিনজন চাকরি হারান। এ ছাড়া সভাপতি লিপি আক্তারসহ প্রায় ১৬ জন শ্রমিককের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয় মালিকপক্ষ।

কারখানাটির ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমানের অভিযোগ, ‘ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই মালিকের লোকজন আমাদের নানা রকম হুমকি দিতে থাকেন। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর কারখানায় ঢুকতে গেলে নিরাপত্তারক্ষী ঢুকতে দেন না। আমার একটি ছবি গেটে লাগিয়ে রাখা হয়। সাত-আট দিন পর্যন্ত সেটি ছিল।’ তিনি জানান, বিজিএমইএতে ওই দিনই বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে কোনো সুরাহা হয়নি।

অন্যদিকে সভাপতি লিপি আক্তার বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার মাথার টিউমার অপারেশন হয়। তাই আমি ছুটিতে। ৯ নভেম্বর আমাকে ডেকে নিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। আমি স্বাক্ষর করতে না চাইলে মালিকের লোকজন আমাকে ভয়ভীতি দেখায়। তারা বলেন আমার স্বামী-সংসার আছে। তাদের ভালোর জন্যই আমার স্বাক্ষর করা দরকার।’

ওয়েল টেক্সের বিষয়টি মার্কিন দূতাবাস মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ই-মেইলে থেকেও সত্যতা মিলে। এতে বলা হয়েছে, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার পর মালিকপক্ষ এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে শ্রমিকদের শাসিয়ে দেয়। এঁদের মধ্যে কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করে। ২৩ অক্টোবর সাধারণ সম্পাদকসহ দুজন কাজ করতে গেলে কারখানায় ব্যবস্থাপক টিপু বলেন, তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া মার্কিন দূতাবাসের ই-মেইলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের গ্লোবাল ট্রাউজারের শ্রমিকেরা যাতে ইউনিয়ন করতে না পারেন, সে জন্য হাইকোর্ট থেকে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা নিয়েছে মালিকপক্ষ। পরে সেটি আবার ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকায় শ্রমিকেরা ইউনিয়ন করতে পারছেন না। এটি বর্তমান সাংসদ মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের মালিকানাধীন।

আরেক কারখানা সাদিয়া গার্মেন্টসের মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ইউনিয়ন ঠেকাতে নিজেদের পছন্দের লোকজন দিয়ে নতুন ইউনিয়ন গঠনের কৌশল নিয়েছে। এ ছাড়া ই-মেইলে বেসিক অ্যাপারেলস, মাসকো, ঈগল আইস ডিজাইন ও রুমানা ফ্যাশনে (ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ)ইউনিয়ন করতে শ্রমিকেরা সমস্যা পড়েন বলে অভিযোগ করা হয়।

বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়নের আগের ইতিহাস ভালো ছিল না বলেই মালিকেরা ভয় পাচ্ছেন। তার পরও কোনো কারখানার শ্রমিকেরা গঠনমূলক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আবেদন করে ইউনিয়ন চাইলে আমরা স্বাগত জানাব। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরুৎসাহিত করলে মালিকদের বোঝাব।’

বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, সমিতির কার্যালয়ে একটি হেল্প ডেস্ক খোলা হবে। সেখান থেকে মালিকেরা এ বিষয়ে জানতে পারবেন। জিএসপি ও পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ইউনিয়ন গঠনে কোনো বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫