রাজনীতিকদের ব্যর্থতার দায় জাতির কাঁধে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বাধীনতার পর এই ৪২ বছরে বাংলাদেশের অনেক অর্জন আছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি আজ অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসব অর্জন উন্নত দেশেও বুক ফুলিয়ে বলার মতো। কিন্তু এখনো গণতন্ত্র চর্চার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় দেশের রাজনীতি নিয়ে প্রায়ই মাথা হেঁট হয়ে যায়। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয় সঙ্কট। সে সঙ্কট সহিংসতায় রূপ নেয়াটা যেন অবধারিত। সহিংসতায় মানুষ মরে, ব্যবসা লাটে ওঠে, শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তা ভোগে কিন্তু এসবে ভ্রুক্ষেপ করে না রাজনৈতিক দলগুলো। তখন বিদেশিরা আসেন জনগণের ত্রাতা হয়ে। এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অমোঘ নিয়তিতে পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, মোড়লিপনা পছন্দ করে না কেউই। এ নিয়ে সচেতন নাগরিকদের ক্ষোভ বাড়ছেই। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও স্বাধীনচেতা জাতির মনে এমনটাই হওয়া উচিৎ। এটা যে কোনো স্বাধীন দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। কোনোভাবেই তা শুভ পরিণতি বয়ে আনে না।

তবে যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনগুলোর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ সেসব বিষয়ে বিদেশিদের ‘বন্ধু’ হয়ে মতামত দেয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে নয়। বাংলামেইলের সঙ্গে আলাপকালে এমন অভিমতই দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।

তারা বলেন, পাকিস্তানের দাসত্ব ও জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আর নিজেদের সার্বভৌমত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেই স্বাধীনতা সার্থক হবে।

তারা এও অভিমত দেন- নিজেদের যে কোনো সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারাটাই স্বাধীনতার মূল স্বাদ। বাঙালি জাতি নিজেদের স্বাধীনতার মূল স্বাদ গ্রহণ করতেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ যে কোনো বিষয়ের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে না পারলে তা হবে পরাধীন থাকারই নামান্তর। স্বাধীন কোনো ভূখণ্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কারো মাতবরি স্বাধীনতার পরিপন্থি। কিন্তু রাজনীতিকদের এ ব্যর্থতার দায় যেন জাতির কাঁধেই পড়েছে। সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চা হচ্ছে কি না, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিত্তি পাচ্ছে কি না, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কীসে এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাদের অপরিনামদর্শিতার জন্য ভুগতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে যারা তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়।

এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ধমকায়। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিল না। এটা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। বিদেশিদের এমন আচরণের সঠিক জবাব দিলেই তারা এমন করার আর সাহস পাবে না। আমাদের সমস্যা যদি আমরাই সমাধান না করতে পারি তাহলে জাতি হিসেবে আমরাই ব্যর্থ।’

নিজেদের দ্বন্দ্বে অন্যদেরকে সুযোগ তৈরি করে দেয়া যাবে না। জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যমতে পৌঁছতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বার্থক হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতো আরো অনেক বিশিষ্টজনের মতে, কিছু অন্যায় আবদার যে বিদেশিরা করবে না তা না। কিন্তু সেরকম আবদার করার মতো আমাদেরকেও যোগ্যতা আর্জন করতে হবে। তবেই তারা আর আমাদের কোনো বিষয়ে নাক গলাবে না। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দেশের নেতা ও নীতিনির্ধারকরা নিজেরা যদি দক্ষ ও যোগ্য হন তবে এ ধরনের অযাচিত চাপ সহ্য করার শক্তি অর্জনের পথে আর বাধা থাকে না।

এমন মত দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও। তিনি বলেন, ‘আসলে বিষয়টি আমাদের জন্য চরম লজ্জার। আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ নই। ইতিহাসে আমাদের বেটার অবদান ও সম্মান রয়েছে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে না পারলে বিদেশিরা মাতবরি করতে চাইবেই। কিন্তু তাদেরকে সে সুযোগ তৈরি করে দেয়া যাবে না।’

আমরা যেসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা সংগঠনগুলোর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ সেসব বিষয় ছাড়া অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে কারো তাবেদারি কাম্য নয়। এখন যা হচ্ছে তার জন্য আমাদের রাজনীতিকরাই দায়ী। কারণ, তাদের ব্যর্থতাই বিদেশি প্রভূদের এ সুযোগ তৈরি করে দেয়। নিজের পরিবারের কোন্দল মেটানোর জন্য যদি বাইরের লোকদের ডাকা হয় তাহলে তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সহজ রাস্তা পেয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবন্ধ সেসব বিষয়ে বিদেশিরা মাতবরি বা মতামত দিতে পারে এটা তাদের অধিকার রয়েছে। কারণ আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনগুলোর কাছে চুক্তিবদ্ধ। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তখনই তারা কথা বলার সাহস পায় যখন আমরা নিজেরা ব্যর্থ হই। তবে এসব বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ আমাদের ব্যর্থতাই দায়ী।’

দেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন চেষ্টায় গত ৬ ডিসেম্বর রাতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের রাজনীতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় আসেন। টানা পাঁচ দিনের সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতে ইসলামী, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। প্রধান দুই দলের মহাসচিবকে দুইবার বৈঠকে বসাতে পেরেছেন তিনি। তাদের কাছ থেকে বৈঠক চালিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন তারানকো। তিনি যাওয়ার পর আর মাত্র একবার বৈঠক করেছে দুই দল। চতুর্থবার বৈঠকে বসার আর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

তারানকো যাওয়ার পর ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। এসময় তিনি সবক’টি দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। এর পরে ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন বৃটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক সিনিয়র প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ারসি। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একই বিষয়ে ঢাকায় আসেন তিনি। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে বৈঠক করেন।

একই বিষয়ে গত ১৬ নভেম্বর তিন দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকায় আসেন। এসময় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সঙ্কট ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন।

একইভাবে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিসহ বিদেশি হ্যাভিওয়েট নেতারা টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা সবাই দেশের এমন পরিস্থিতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন।

বিশেজ্ঞরা বলছেন, যেক’টি বিষয় নিয়ে তারা আমাদের দেশে এসেছেন এসব বিষয় আমরাই সমাধান করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের সদিচ্ছা না থাকায় বিদেশিরা মতবরি করতে বাধ্য হয়েছে। কেননা নির্বাচন একটি মানবাধিকার। আর যখন এদেশের মানুষের অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তখন তারা তো মতবরি করবেই।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আসলে এখন বিশ্বটা গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে। কিছু কিছু বিষয়ে রয়েছে যে বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের স্বার্থ সম্পৃক্ত সেসব বিষয়ে তাদের বলার অধিকার রয়েছে। তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ যে কোনো বিষয় নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে পারেন না। এ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্যই আমরাই দায়ী।’

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধ থাকবে। আমাদের জনগণই এ সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিদেশিদের হাত দেয়া কাম্য নয়। এমন হলে তা আমাদের ব্যর্থতা বলেই গণ্য হবে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫