অগ্নিদগ্ধ চব্বিশ জনের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ যন্ত্রণায় ছটফট করছে শিশু সুমী। দীর্ঘ দেড় মাসেও সে সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তার বায়না সে বাসায় ফিরে যাবে। যাকে দেখছে তার কাছেই জানতে চাচ্ছে, আর কতদিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে? কবে ফিরবে বাড়ি? একটুও ভালো লাগছে না তার। প্রায় দেড় মাস হাসপাতালের বেডে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এ শিশু। তার আর্তি কতদিন বাড়ি যাইনি। বাড়ি যাব। শুধু সুমী নয়, অবরোধের সহিংসতার আগুনে পুড়ে তার মতো এখনও ২৪ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের সুস্থ হতে এখনও সময় লাগবে। এদিকে দগ্ধদের অনেকে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় গেলেও আতংক ছায়ার মতো তাড়া করে বেড়ায় তাদের। অনেকের শরীরের পোড়া অংশে সৃষ্টি হয়েছে ঘা । হাসপাতালে আবার ভর্তিও হচ্ছেন অনেকে। এমনই একজন শাহবাগের আগুনে দগ্ধ গীতা সেন বার্ন ইউনিট ছেড়ে ১১ দিনের মাথায় আবার ভর্তি হয়েছেন। আহতদের অনেকেই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এ কারণে সংসারে নেমে এসেছে অভাব-অনটন। পরিবারের সদস্যরা খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছেন।

গত ২৭ অক্টোবর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল ও অবরোধের সহিংসতার আগুনে দগ্ধ হয়ে মোট ১২৫ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৬ জন। এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা মাসুমা ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সহিংসতার ঘটনায় বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ২৪ জন। দুজনকে রাখা হয়েছে আইসিইউ বিভাগে। এর মধ্যে শাহবাগে বাসের আগুনে দগ্ধ ৬ জন এখনও চিকিৎসাধীন। ওই ঘটনায় ১৮ জন ভর্তি হলে চারজনের মৃত্যু হয়। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও তাদের মধ্যে আতংক কাটেনি। বার্ন ইউনিট থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

শাহবাগের আগুনে ছয়জন: গত ২৮ নভেম্বর দুর্বৃত্তরা শাহবাগে চলন্ত বাসে পেট্রল বোমা ছুড়ে মারে। সঙ্গে সঙ্গে বাসে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাসে থাকা ১৮ জন দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে কলেজছাত্র অহিদুর রহমান বাবু, রবিন, নাহিদ ও সর্বশেষ ব্যাংক কর্মকর্তা মাসুমা মারা যান। ওই আগুনে দগ্ধ গীতা সেনের অবস্থা উন্নতি হলে ৫ ডিসেম্বর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু বাসায় ফিরে আসার কয়েক দিন পর তার অবস্থার অবনতি ঘটে। ফলে ১৬ ডিসেম্বর আবারও বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন তিনি। শনিবার সকালে গীতা সেন বলেন, একটু সুস্থ অনুভব করায় ছুটি নিয়ে বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় গিয়ে ঘা দেখি ঘা দগদগ করে ওঠে। যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না। এ জন্য আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। বাসের মধ্যে আগুনের স্মৃতি মনে করতেই তিনি শিহরে ওঠেন। বলেন, ওই ঘটনা যেন কারও জীবনে না ঘটে। ভয়াবহ দৃশ্য। একটি শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। যাত্রীদের বাঁচার চিৎকার।

ওইদিনের কথা মনে উঠলে, কেঁপে উঠি। মৃত্যু থেকে বেঁচে গেছি। ওই আগুনে গীতা সেনের মেয়ে সুস্মিতা সেনও পুড়েছিল। সে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরলেও আঁতকে উঠছে বলে জানান মা গীতা সেন। গীতা সেন আরও বলেন, সুস্মিতা পুড়ে যাওয়া শরীরের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। বার্ন ইউনিট থেকে জানা গেছে, শাহবাগের আগুনে গীতা সেনসহ ছয়জন এখনও চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে পুলিশের এএসআই নুর নবীকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। নুর নবীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, তার পিতার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে একটু উন্নতি হয়েছে। তবে যন্ত্রণা আছে। মাঝে-মধ্যেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন তার পিতা। চিকিৎসাধীন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রাহাজুলের দরিদ্র কৃষক পিতা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার সব স্বপ্ন আগুনে পুড়ে গেছে।

আমি গরিব মানুষ। পড়ালেখা জানি না। ছেলেকে পড়ালেখা করানোর খুব ইচ্ছা থাকলেও অভাবের সংসার বলে তার খরচ দিতে পারতাম না। সে নিজে চাকরি করে ঢাকায় পড়ালেখা করে। রাহাজুল কবে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবে তা ভেবেই চোখের জল ফেলছেন অবুঝ পিতা। তিনি বলেন, এখন আমার আর কোনো কিছুর দরকার নেই, ছেলে বেঁচে গেলেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। তার গ্রামের বাড়ি পাবনায়। তার শরীরের ২৫ ভাগ পুড়ে গেছে। ছয়জন চিকিৎসাধীনের মধ্যে আরেকজন আবু তালহা। তার শরীরের ৩৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। সুস্থ হয়ে কবে বাসায় ফিরবেন এ চিন্তা তাকে যেন ছাড়ছেই না। বলেন, চিকিৎসকরা বলেছেন, আরও অনেক দিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। আরও দু’জন চিকিৎসাধীন আমজাদ হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা।

এখনও ছয় ব্যাগ রক্ত: কুমিল্লায় দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ সিএনজিচালক রুবেল মিয়ার শরীর থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ পর্যন্ত তার শরীরে ১৪ ব্যাগ রক্ত দিয়েও তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসকরা বলছেন, এখনও অন্তত ছয় ব্যাগ রক্ত তার শরীরে দিতে হবে। ২৫ নভেম্বর দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে সিএনজিচালক রুবেল মিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। তার বাসা কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার উনাশ্বিয়া এলাকায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হাসপাতালে থাকায় ছেলেমেয়েদের অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হয়েছে। তার তিন ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করেন। রুবেলের স্ত্রী নাছিমা জানান, বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ ও সংসারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে মাস শেষে আয়-ব্যয় সমান সমান। কোনো সঞ্চয় ছিল না। তিন ছেলেমেয়েকে বাসায় রেখে আমি স্বামীর কাছে আছি। ছেলেমেয়েদের চাল কিনে দেয়ার মতো সামর্থ্য নেই। বাড়িওয়ালা (ভাড়া বাসার মালিক) তাদের খেতে দিচ্ছেন। রুবেলের শরীরের ২৩ ভাগ পুড়ে গেছে। তার সেরে উঠতে এখনও অনেক দিন লাগবে। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন রুবেল ও নাছিমা। নাছিমা বলেন, বছরের শুরুতে তিন ছেলেমেয়েকে নতুন ক্লাসে ভর্তি করতে হবে। ‘ও’ (রুবেল) সুস্থ হয়ে না উঠলে কি করে ছেলেমেয়েদের খরচ পূরণ করব ভেবে পাচ্ছি না। ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় কুমিল্লার কচুয়া চৌমুহনী এলাকায় ৫-৬ তরুণ তার চলন্ত অটোরিকশায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

গত ১০ নভেম্বর ধানমণ্ডিতে দুর্বৃত্তরা একটি লেগুনায় আগুন দিলে দগ্ধ হয় হেলপার শিশু মিলন ওরফে শ্যামল। র্বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন মিলন এখনও সেই আগুন আতংকে ভুগছে। মিলন জানায়, তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সে আর কখনও লেগুনায় যাবে না বলে রিকশাচালক বাবা আমান উল্লাহ সরদারের কাছে আবদার ধরেছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই শিশুর ভবিষ্যৎ কি তাও জানেন না গরিব বাবা। শুধু আগুনের ধোঁয়ার মতো ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন তিনি।

গত ৪ নভেম্বর দগ্ধ শিশু সুমী ও তার দাদি রহিমা বেগম এখনও সুস্থ হয়ে ওঠেননি। প্রায় দেড় মাস বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। সুমীর মা রুবিনা জানান, শনিবার সুমীর অপারেশন করা হয়েছে। সুমী এখনও যন্ত্রণায় ছটফট করে। শিশু সুমী এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চায়, আর কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে? একটুও ভালো লাগছে না হাসপাতালে থাকতে। কতদিন হল বাড়ি যাইনি। বাড়ি যাব। ৪ নভেম্বর নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে একটি বাসে উঠেছিল ঢাকায় আসার জন্য। উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরে সুমীর ফুফু রাবেয়ার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। এর আগেই ওইদিন সন্ধ্যায় গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তায় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে তাদের বহনকারী বাসটি পুড়ে যায়। এতে দগ্ধ হয় সুমীসহ তার দাদি।

হরতাল ও অবরোধে সহিংসতার আগুনে দগ্ধ আরও চিকিৎসাধীন আছেন ১৮ ডিসেম্বর গ্রিন রোডে দগ্ধ আবেদ, ১৭ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জে দগ্ধ শাহাদাত, ৬ ডিসেম্বর শ্যামপুরে দগ্ধ জাহানারা, বরিশালের সুলতান সরদার, ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর পশ্চিম রামপুরায় দগ্ধ নিজাম, মেহেরপুর দগ্ধ মুনিয়া, ১২ নভেম্বর রাজধানীর রায়েরবাজারে দগ্ধ শুভ ও আবুল কালাম, হাজারীবাগে দগ্ধ আলামিন, ১ নভেম্বর লক্ষ্মীবাজারে লেগুনায় দগ্ধ কামাল হোসেন, চট্টগ্রামের সিএনজি চালক খোরশেদ আলম, কুমিল্লায় দগ্ধ মজিবর, আশুলিয়ায় দগ্ধ সুমন ও ময়মনসিংহে দগ্ধ হারুন অর রশিদ। তারা হরতাল ও অবরোধ সহিংসতার আগুনে পুড়ে দগ্ধ হন।

বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল রোববার বলেন, ২৭ অক্টোবর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের সহিংসতায় ১২৫ জন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এখনও ২৪ জন ভর্তি রয়েছেন। ১৮ ডিসেম্বরের পর সহিংসতার আগুনে দগ্ধ হয়ে কেউ বার্ন ইউনিটে আসেননি বলে জানান তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫