বাংলাভ’মি২৪ডেস্ক ॥ সিজোফ্রেনিয়া কি? মনোচিকিত্সক ডা. ইন্দ্রনীল সাহার সঙ্গে কথা বলে জানালেন সুজাতা মুখোপাধ্যায় জেনারেল ফিজিশিয়ান। লাগাতার প্র্যাকটিস করেন। একটু মফঃস্বলে যেমন হয়, বুদ্ধি-পরামর্শও দেন রোগীদের। কখনও তাঁদের ব্যক্তিগত সমস্যার হাল করে দেন। তো, এহেন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মানুষটির সঙ্গে কথা হচ্ছিল মনোচিকিত্সক ডা. ইন্দ্রনীল সাহার। খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর তিনি একটি প্রেশক্রিপশন বার করে দেখালেন বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাদের পেশেন্ট, বুঝতে পারছেন তো?’ অবাক ডা. সাহা, দীর্ঘদিন ধরে এত রোগী ঘাঁটাঘাঁটির পরেও তিনি টের পাননি যে এই মানুষটি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। অবশ্য সত্যি বলতে গেলে, অবাক হওয়ারও কিছু নেই। এত ভালো ভালো ওষুধ বেরিয়ে গেছে আজকাল যে সময়ে চিকিত্সা শুরু হলে, অধিকাংশ রোগীকেই আর দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে তিনি এতে আক্রান্ত। একটু-আধটু ওজন-টোজন বাড়ে, এঁর ক্ষেত্রে তাও নয়৷ দিব্যি ছিপছিপে, ফিটফাট মানুষ। বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তাধারা, কোথাও এতটুকু ছাপ নেই। অথচ বছর ২০ আগে যখন সুরু হয়েছিল…।
সবে তখন ডাক্তারি পাশ করে ইনটার্নশিপ করছেন৷ ২৩-২৪ বছর বয়স। আউটডোরে বসে রোগী দেখছেন একদিন, হঠাত্ কানে এল অশ্রব্য ভাষায় কে যেন গালাগাল করছে তাঁকে। চারপাশে রোগীর ভীড়৷ এদিক ওদিক চেয়ে বুঝতে পারলেন না কিছু। কান গরম হয়ে উঠল শুধু। হাতের কাজে মন দিতে যাবেন, আবার সেই। রোগী ছেড়ে উঠে দু-মিনিট ঘুরে এলেন। তারপর সব ঠিক। দু’দিন পর আবার হোস্টেলের ঘরে একা শুয়ে ছিলেন। ত্রিসীমানায় কেউ নেই। তাহলে? স্পষ্ট তার নাম শুনেছেন৷ মন খারাপ হয়ে গেল। তবে কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন!
এরপর বাড়তে লাগল সমস্যা৷ মাঝে মাঝেই গালাগাল ভেসে আসে কানে৷ কাউকে চিহ্নিত করতে পারেন না! অস্থির মনে সবাইকে সন্দেহ করতে লাগলেন৷ এরপর শুরু হল অসংলগ্ন কথা৷ এই হল প্যারানয়েড স্ক্রিত্জোফ্রিনিয়া৷ নিরিহ গোত্রের স্ক্রিত্জোফ্রিনিয়া এটাই।
২০ বছর বাদে আজও ফলোআপ করে যেতে হয় তাঁকে। শুধু এটুকু ছাড়া আর পাঁচজনের মতো স্ত্রী-সন্তান-পরিবার-ডান্ডারি সব কিছু নিয়ে দিব্যি আছেন। স্ক্রিত্জোফ্রিনিয়া নিয়েও যে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন তার জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ তিনি।
কেন হয়?
উপসর্গ এবং রোগের জটিলতার উপর নির্ভর করে সিজোফ্রেনিয়াকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে- ১) প্যারানয়েড ২) হেভেফ্রেনিক ৩) ক্যাটাটোনিক ৪) আনডিফারেন্সিয়েটেড। প্যারানয়েড ও ক্যাটাটোনিক টাইপের অসুখে চিকিত্সার ফলাফল খুব ভালো। আনডিফারেন্সিয়েটেডে মোটামুটি। হেভেফ্রেনিক রোগের কবলে পড়লে চরম বিপদ। একেবারে উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন রোগী।
মা বা বাবার থাকলে সন্তানের হওয়ার আশঙ্কা ১০-১২ শতাংশ। দু-জনের থাকলে তা বেড়ে হয় ৪০ শতাংশ৷ ঠাকুমা-দাদু-দিদি-মাসি-পিসি-কাকা-মামার মধ্যে কারও থাকলে ৪-৬ শতাংশ চান্স। এক রকম দেখতে যমজ বাচ্চার মধ্যে একজনের হলে ৪০-৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্য জনেরও হয়।
শরীরে জিন থাকলেই যে রোগ হয় এমন নয়৷ পরিবেশ অনুকূল হলে জিনের প্রবল ডাক উপেক্ষা করে মানুষ সুস্থ থাকতে পারেন। আবার প্রতিকূল পরিবেশে জিনের সামান্য প্রতিবন্ধকতা বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কাদের রিস্ক বেশি
১৬-৩৫ বছর বয়সের মধ্যে রোগ হয় সাধারণত৷ ছেলেদের বেশি হয় ২০ বছরের আশপাশে। মেয়েদের ৩০-৩৫-এ। বাচ্চাদেরও হচ্ছে আজকাল৷ মোটামুটি ৬-৭ বছর বয়সে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
এই রোগে ভুগলে বেশ কিছু নতুন উপসর্গ দেখা দেয়, যাকে বলে পজিটিভ সিম্পটম। নিজেকে বহু কিছু থেকে গুটিয়ে নেন মানুষ, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম নেগেটিভ সিম্পটম। বিচার-বুদ্ধি, স্মৃতি, মনোযোগ, একাগ্রতায় যে অসংগঠিত আসে তার নাম কগনিটিভ সিম্পটম।
পজিটিভ সিম্পটমের মধ্যে প্রধান হল হ্যালুসিনেশন। এমন কিছু মানুষটি দেখতে বা শুনতে পান যা অন্য কেউ পান না৷ কেউ শোনেন, তাঁকে গালাগাল করা হচ্ছে। কারও কানে ভেসে আসে অন্য কোনও কথা৷ কারও থট ইকো হয়৷ তিনি হয়তো ভাবলেন চা খাবেন বা শুতে যাবেন, সঙ্গে সঙ্গে হয় নিজের গলায় নয়তো অন্যের গলায় শুনতে পাবেন, ‘এবার একটু চা খেলে হয়’, বা ‘যাই এবার শুয়ে পড়ি।’ রানিং লাইভ কমেন্ট্রি শুনতে পান অনেকে। স্নান করছেন, খাচ্ছেন, আর অনবরত কানের কাছে কেউ যেন বললে চলেছেন, ‘এই তো স্নান করছে, কল খুলল, জল পড়ছে…, গা মুছছে, জামা-কাপড় পরছে…এবার খেতে বসছে, ভাত-ডাল খাচ্ছে, মাছ খাচ্ছে…।’ কম্যান্ড হ্যালুসিনেশন হয় অনেকের। শুনতে পান কেউ তাঁকে কিছু করতে বলছেন, আর তিনি গিয়ে সেটা করে আসছেন। কাউকে হয়তো মেরেধরে এলেন, কি খুনই করে ফেললেন৷ কারণ তিনি শুনতে পাচ্ছেন কেউ তাঁকে বলছেন, এগুলো করলে তাঁর ভালো হবে।
ডিলিউশন হয় অনেকের৷ ভ্রান্তি। ভাবনা-চিন্তা, বিশ্বাস গুলিয়ে যায়। অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন। কখনও একা একা নিজের মনে৷ কথা বলতে বলতে মাঝপথে খেই হারিয়ে যেতে পারে, কথা আর না খুঁজে পেতে পারেন, এমন কোনও শব্দ ব্যবহার করতে পারেন যার কোনও অস্তিত্বই নেই৷ এবং অন্যরা যে এ সব কথা বুঝছেন না তা তিনি বুঝতে পারেন না।
নির্বিকার হয়ে যায় চোখ-মুখ। কাজের আগ্রহ, মেলামেশার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায়। স্নান করা পরিচ্ছন্ন থাকা, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি সব বোধই চলে যায় ধীরে ধীরে।
মনোযোগ, বিবেচনা, স্মৃতি, কাজের ক্ষমতা এলোমেলো হয়ে যায়।
কিছু মুভমেন্ট ডিসঅর্ডারও হয়। যেমন, একভাবে বসে আছে তো বসেই আছে, একভাবে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে। হাত একভাবে নাড়িয়েই যাচ্ছে, চোখ পিটপিট করছে বা এককতা বার বার বলে যাচ্ছে।
ধরা পড়লে কী করবেন?
উপসর্গ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সা শুরু হলে দ্রুত ভালো ফল হয়। প্যারানয়েড ও ক্যাটাটোনিক সিজোফ্রেনিয়া রোগী প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যান। কম বয়সের রোগীদের তুলনায় বয়স্ক রোগীদের চিকিত্সার ফলাফলে বেশি ভালো হয়।
এরপর শুরু হয় সাইকোথেরাপি। নিয়মমাফিক থেরাপি করলে রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ে, চিন্তায় পারম্পর্য আসে, মিলেমিশে চলার দক্ষতা তৈরি হয়।
ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ে রোগী কী করে কথা বলবেন, নিজের কাজ করবেন, হিসেব রাখবেন, যাতায়াত বা বাজার করবেন ইত্যাদি শেখানো হয়।
ফ্যামিলি এডুকেশন সেশনে আত্মীয়দের শেখানো হয় কীভাবে সহানুভূতির সঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাঁকে নিয়ে চলতে হবে৷ খারাপ ব্যবহার বা মারধোর না করা, নিয়মিত যাতে তিনি ওষুধ খান বা ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করেন সে দিকে খেয়াল রাখাও বাড়ির লোকেরই কাজ। দেখা গেছে যে সমস্ত রোগীদের পারিবারিক সাপোর্ট ভালো তাঁরা বেশি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠেন।
ওষুধে রোগীর ইনসাইট ফিরে এলেও ভুলভাল দেখা বা শোনার পর্ব আরও কিছু দিন চলতে পারে। এই সমস্যা কাটাতে করা হয় কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। এতে শেখানো হয় হ্যালুসিনেশন হলে কীভাবে তা ডিল করতে হবে।
এছাড়া সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে সেল্ফ হেল্প গ্রুপ থেরাপি ও সোসাল স্কিল ট্রেনিংও দেওয়া হয়৷ দেখা গেছে শিক্ষিত, বিচক্ষণ ও মিশুকে মানুষের যদি এই অসুখ হয়, তাঁরা অন্যদের তুলনায় তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সূত্র: এইসময়।