স্টাফ রিপোর্টার ॥ আওয়ামী লীগ-বিএনপি বড় দুই দলই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আওয়ামী লীগ চাইছে বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলেও অধিক সংখ্যক দলের অংশগ্রহণ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে নির্বাচন। অপরদিকে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কাজ করছে এর বিপরীত ধারায়। তারা চেষ্টা করছে সরকারি দলের প্ররোচনায়, প্রলোভনে কোন দল যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয়। যত অধিক সংখ্যক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যায়। দেশের মানুষকে নির্বাচনবিমুখ করে তোলা। তফসিল ঘোষণার পর পরই গোটা দেশকে অচল করে দেয়ার জন্য বিরোধী দলের ঘোষণা সরকারের জন্য যেমনি তাদের জন্যও চ্যালেঞ্জিং। বিক্ষোভ মিছিল, অবরোধ, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হবে বিরোধী দলের হাতিয়ার। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এসব কর্মসূচি সফল করার মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করা বিরোধী দলের জন্য কঠিন পরীক্ষা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা, আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীদের প্রতিরোধ মোকাবিলা করতে হবে তাদেরকে। এতে করে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে আসবে। পরিণতিতে সরকার তার মেশিনারি ব্যবহার একতরফা নির্বাচন হয়তো করিয়ে নিতে পারবে কিন্তু ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে না। জনমনে স্বস্তি আসবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এদিকে সংঘাত এড়াতে বিদেশী কূটনীতিকরা মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠানে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। তফসিল ঘোষণার আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আলোচনার টেবিলে বসাতে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছেন। ঢাকাস্থ মার্কিন, জার্মানি, চীনা ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ও ড. ওসমান ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। একসঙ্গে বসে উভয়পক্ষকে ছাড় দিয়ে ন্যূনতম সমঝোতায় আসার তাগিদ দিয়েছেন। সৈয়দ আশরাফের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আশরাফও একসঙ্গে বসার কথা বলেছেন। তবে তিনি কোন তারিখ দেননি। পক্ষান্তরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যে কোন সময় যে কোন স্থানে বসতে তাদের আগ্রহের কথা জানান। সংলাপের ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফের কাছ থেকে জরুরি তাগিদ না পাওয়ার মানসিকতা কূটনীতিকদের হতাশ করেছে। সহসা মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকের কোন সম্ভাবনা তারা দেখছেন না। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের সদিচ্ছা দেখাতে বৈঠক যদি হয়ও তা হবে নিতান্তই লোকদেখানো। কোন সমাধান আসবে না। নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান প্রশ্নে দুই পক্ষেরই অনড় মনোভাব সংলাপকে অর্থহীন করবে।
নির্বাচন কমিশন সোমবারই তফসিল ঘোষণা করবে। তফসিল ঘোষণার পর সংলাপের কোন গুরুত্ব থাকবে না। সরকার বিরোধী দল ছাড়াই সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দ্রুত একতরফা নির্বাচন করিয়ে নিতে চাইছে। এ কারণে সাধারণ সম্পাদক-মহাসচিবের মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ খুব কম। বিরোধী ও সরকারি দল পরস্পর বিপরীত মেরুতে থাকায় তাদের মধ্যে সমঝোতারও কোন সুযোগ নেই। নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। সরকারে জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী এবং বিরোধী দল যোগ্য, জনপ্রিয় প্রার্থী দিলে তাদের জয় নিশ্চিত মনে করেই তারা নির্বাচনে আগ্রহী। কিন্তু সরকার ন্যূনতম ছাড় না দিলে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে তাদের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে নামা আত্মঘাতী হবে বলে করছেন তারা। তাই সরকার নিজেদের পরাজয় ঠেকাতে তাদের সে সুযোগ দিতে রাজি নয়। বিরোধী দলের প্রধান দাবিই হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরে যাওয়া। নির্বাচিত অন্য কোন প্রতিনিধিকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে নমনীয়তা রয়েছে। এব্যাপারে সরকারের বর্তমান অবস্থান কঠোর। তাদের আশঙ্কা, এ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর উদারতা তার দলের জন্য কাল হয়ে দেখা দেবে। কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়বেন। বিরোধী দল একে তাদের বিজয় বলে প্রচার চালিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা মনোবল নিয়ে নির্বাচনী মাঠে অবতীর্ণ হবে। সরকারের একজন নীতিনির্ধারক বলেন, এমনি সবদিক বিচার বিবেচনা করেই সরকার অগ্রসর হচ্ছে।
এদিকে সরকার অধিক সংখ্যক দলকে নির্বাচনে আনার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। সিপিবি-বাসদ, গণফোরাম, জেএসডি (রব), চর মোনাইর পীরের ইসলামী আন্দোলন, জাকের পার্টি এবং ১৮ দলীয় জোটের এলডিপি, খেলাফত মজলিস, বিজেপিকে নির্বাচনে আনার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে কথা হচ্ছে। বিএনপি থেকেও এদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। সরকার চার অধিক সংখ্যক দলের অংশগ্রহণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার উপস্থিতি দেখিয়ে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা লাভ। কোনরকমে একটি নির্বাচন করানোর মাধ্যমে সাংবিধানিক শূন্যতা এড়ানো এবং পরবর্তী দু’ বছরের মধ্যে সকলের অংশগ্রহণে নতুন জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। আপাতত বিরোধী দলের নির্বাচন প্রতিহত করার কর্মসূচি মোকাবিলা করাই সরকারের সামনে এখন বড় বিষয়। ব্যাপক ধরপাকড়, থানা পুলিশের বাড়ি বাড়ি হানা দেয়ার পাশাপাশি সরকারি দল রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে বিরোধী দলকে। এতে সংঘাত, সংঘর্ষ বেড়ে তা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সহিংস ঘটনা প্রবাহ যাতে দেশের শান্তিপ্রিয় ভোটারদের নির্বাচন বিমুখ করে না তোলে সেদিকে সতর্ক থেকেই কর্মপন্থা নিতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে, সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই নিশ্চয়তা বিধান এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।