বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ বছর আটেক হবে। দু’দিনের ছুটির ফুরসতে গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গল। চা খাই। সব আড্ডায় চায়ের উপস্থিতি অনিবার্য। অথচ সেই চায়েরই জন্মবৃত্তান্ত জানা হয়নি। শ্রীমঙ্গল টি বোর্ডের রেস্ট হাউজে থিতু হয়েছিলাম। গিয়েই খোঁজ নিতে শুরু করি এর বাইরে দেখার কি আছে। মানবজমিন প্রতিনিধি কামরুল আম্বিয়া জানালো সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা আছে দেখার মতো। ঢাকায় চিড়িয়াখানা দেখেছি কিন্তু সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা? এটা কেমন হবে? কামরুল আম্বিয়ার স্বগতোক্তি, আর যাই হোক আপনি ওখানে গেলে লজ্জাবতী বানরের দেখা পাবেন। কিন্তু আমি যে লজ্জাবতীকে চিনি। সে তো বানর নয়। সে থাকে আমার পথের ধারে। বুনো ঝোপঝাড়ে। সে ওত পেতে থাকে খালি পায়ে ইশকুল যাওয়ার পথে খানিকটা সময় নিতে। যাকে দেখলে ছেলেবেলার অভিমান আর খুনসুটি, শ্রেণীকরে ধ্বস্তাধ্বস্তি সব যেতো খেই হারিয়ে।
যখন পথের ধারে, ধান আর পাটের আইল ধরে তুমি থাকতে দাঁড়িয়ে। নরম নরম আলতো পায়ের ছোঁয়াতে তুমি দিতে ভুলিয়ে। সব ফেলে বুকের চাপা বইগুলো নিয়ে আমি যেতাম ঠায় দাঁড়িয়ে। এটা ওটা পারা যায় যতটা। শেষ পর্যন্ত । আরও চাই। ওই দেখা যাচ্ছে। আবারও খানিক পরে যেই তুমি, সে-ই। তোমার তাতে কমতি নেই। নেই অভিমান। নেই রাগ বালাই। লাজ রাঙানো লজ্জা ভুলে যেই সরতাম, তুমি দাঁড়াতে মাথা তুলে। তুমি অবাক করা এক কৌতূহল ছিলে। ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়ে যেখানে গিয়েছি। তোমার অস্তিত্ব আছে এক রোমাঞ্চিত অনুভবে। কি মামার বাড়ি, কি ইস্টিশনে, কি পূজার মণ্ডপে, কি নদীর ওপারে চড়ে, কি মাষকলাই আর ধানের েেতর আইলে।
ঋষিঠাকুরের বাইল্যা শিা (বাল্যশিা) পড়ার সময় মনে পড়ে থাকতো কখনও সখনও লাজুক লতার দিকে। গুরুদেবের বাসার পেছনে নামলেই ছিল লম্বা মাঠ। আর মাঠ পেরিয়ে নদীর পাড়। এখন আর এসব নেই শুধুই স্মৃতির বন্দনা। ছেলেবেলায় একেবারে যখন শিশু, মায়ের কোলে চড়ে বছরে একবার যাওয়া হতো অষ্টমী স্নানে। হিন্দু পৌরাণিক রীতি অনুযায়ী রাবণ কর্তৃক সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পথে যেসব স্থানে সীতা তার হাতের কাঁকন, বালা ও নানা চিহ্ন রেখে গেছেন সেই স্থানগুলোকে পুণ্যার্থীদের জন্য পবিত্র বলে ধরে নেয়া হয়। কুলিয়ারচর থেকে ডুমুরকান্দা। সেখানেই ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা, যেখানে অষ্টমী তিথিতে মেলা বসে। আশপাশের সব পুণ্যার্থীরা মঙ্গল কামনায় এখানে এসে ভিড় জমান। আর ইস্টিশন পেরিয়ে, রেলওয়ের স্লিপারে হাঁটি হাঁটি পা করে, কখনও কোলে, কখনও হেটে ডুমুরকান্দা যেতে যেতে যেই না পা লেগেছে মুখ ঢেকেছে লজ্জাবতী। কে আর ঠেকায়। একাধারে হাতের ছোঁয়ায় লজ্জা ঢাকো। তাইতো কবি লিখেছেন, প্রথম জাগ্রত সৌন্দর্যের মতো, আপন প্রকাশে বিস্মিত, বীণার প্রথম সুরটির মতো, মধুর মরমে জড়িত।
অবাক লাগে, আমেরিকার মেক্সিকোর বাসিন্দা লজ্জাবতী নাথবতী অনাথের মতোই আমাদের পথের ধারে, েেতর আইলে অধিকতর জঙ্গল এলাকায় অঢেল ছড়িয়ে থাকে। সে যেন লজ্জা রাঙা লাজুক লতার মতোই মুখ লুকিয়ে থাকা অবুঝ তরুণী। ছুঁয়ে যাওয়া অবোধ ভালবাসা। নতুন বউয়ের মতোই আলতো ছোঁয়াতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। লজ্জাবতীকে সজোরে আঘাত করলে প্রতিঘাতেরও ভয় আছে। গুল্ম জাতীয় এই লতার গায়ে রয়েছে ঘন কাঁটা। তবে গোড়ার দিকে এই কাঁটার পরিমাণ বেশি। জোরে আঘাত করলে কাঁটা লাগে। বহুবার তারুণ্যের উদ্দামতায় কত দ্রুত লজ্জাবতীকে পরাস্ত করা যায় তা করতে গিয়ে হাতে কাঁটা বিঁধিয়েছি। দু’-একবার লজ্জাবতীর আগা ছিঁড়ে বাড়িতে বসত ঘরের আইল ধরে মাটি খুঁড়ে ছেঁড়া লতায় জল ঢেলেছি। যদি বাড়িতে লজ্জাবতী থাকে তাহলে কতই না মজা। যখন খুশি লজ্জাবতীকে বিরক্ত করা যাবে। এক অনাগত সৌন্দর্যের খেলায় মগ্ন থাকা যাবে। কিন্তু বন্যেরা বনে সুন্দর। সে যে ভেতর বাড়ির নয়।
বাড়িতে একটু একটু জল ঢেলেছি। কখনও গোবর সার দিয়েছি। তাতে কি, শেষে না বলেই বিদায় নিয়েছে। মন খারাপ করে ফিরে গিয়েছি জংলায় থাকা লজ্জাবতীর কাছে। কখনও সখনও কাঁটার আঘাত লাগলেও লজ্জাবতীর গোলাপি ও সাদা রঙের মন হরণকারী ফুলের দল রঙিন স্বপ্নের ইশারায় উজ্জীবিত করতো।
লজ্জাবতীর এই স্পর্শকরতা নিয়ে এন্তার গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, লজ্জাবতী গাছের পাতার গোড়াটা একটু ফোলা থাকে। এই ফোলা অংশের ভিতর থাকে বড় বড় কোষ। এসব কোষ যখন পানি ভর্তি থাকে তখন গাছের পাতার বোঁটা ফুলে ওঠে এবং ডাঁটা সোজা হয়। লজ্জাবতী গাছে কেউ স্পর্শ করলেই তার গায়ে এক ধরনের বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এদের শরীরে অ্যাসিটাইলিন নামে এক প্রকারের রাসায়নিক পদার্থ আছে। যা অ্যাসিটাইলিন কোলিন পদার্থের মাধ্যমেই এই বিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে ওদের সাড়া অঙ্গে। তখন এই রাসায়নিক পদার্থই দ্রুত এক কোষ থেকে আরেক কোষে ছুটতে থাকে।
এর ফলে লজ্জাবতী গাছের কোষ থেকে খনিজ লবণ বেরিয়ে আসে। খনিজ লবণ বের হয়ে আসার সঙ্গে কোষে যে পানি জমা ছিল তা-ও বেরিয়ে আসে। পানি বের হওয়ায় এর কোষগুলো চুপসে যায়। ফলে তাদের শক্তি ও চাপ কমে যায়। তখন গাছের পাতাগুলো দুর্বল হয়ে নুয়ে যায়। এই অবস্থা কিছুণ থাকে। আবার বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে কোষে পানি জমতে থাকে, গাছটিও তখন পুনরায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। লজ্জাবতীর একটি গুণের কথা বলে শেষ করি, কাঁটা থাকায় সাপের বংশ সব সময় লজ্জাবতীর আবাস এড়িয়ে চলে।