স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রার্থী নয় দলভিত্তিক নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ প্রস্তাব তুলে ধরেন। এরশাদের নতুন নির্বাচনের রূপরেখা অনুযায়ী নির্বাচনে কোন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। দল নির্বাচন করবে। দলীয় ভোটের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। জাপা চেয়ারম্যান তার প্রস্তাবনায় জানিয়েছেন, কোন দল নির্বাচনে ন্যূনতম ১ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে তাদের তিনটি আসন থাকবে। সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ তার প্রস্তাবনার পে যুক্তি তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, সংবিধান তো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব এবং সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনে পাওয়া ভোটের অনুপাতে সংসদে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যদি কোন দল ভোট ভোটের শতকরা ৫০ ভাগ পায়, তাহলে সংসদে তাদের আসন থাকবে ১৫০টি।
এরশাদ বলেন, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে দলগুলো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় তারা স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে। সংবিধান কাটাছেঁড়া করার সুযোগ পায়। এটি থাকা উচিত না। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। কোন দলের সদস্য পদত্যাগ করলে বা মৃত্যুবরণ করলে ওই দলের প্যানেল থেকেই শূন্য আসনে প্রার্থী দিতে পারবে। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার করা হলে নির্বাচন কমিশন বহাল থাকবে, নির্বাচনকালের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না। এরশাদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমি শঙ্কিত। সব দল নির্বাচনে আসবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, যারা নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাদের পুঁজি সন্ত্রাস। জনপ্রতিনিধি হয়ে যান গডফাদার। তাদের ইশারায় গড়ে ওঠে সন্ত্রাসী বাহিনী। তারা এলাকা শাসন করে। অর্থ বিত্তশালীরা হয় চাঁদার টার্গেট। দুর্বলের ওপর চলে অত্যাচার। নির্যাতন-নিপীড়ন না চালালে কেউ ভয় করে না। আর ভয় না থাকলে ভোট আসে না। এদের পুষতে হয়। না পুষলে গডফাদার হওয়া যায় না। গডফাদার না হলে নেতার আসন পাওয়া যায় না। এ বাস্তবতার কারণে সন্ত্রাস চলতে থাকে। চাপে পড়ে কিছু সময়ের জন্য হয়তো সন্ত্রাস চাপা থাকে; কিন্তু নির্মূল হয় না।
এরশাদ বলেন, দলভিত্তিক নির্বাচন হলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেেিত কোন সদস্যদের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করলে তাকে সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে। সে েেত্র দল আর প্যানেল থেকে নতুন সদস্য মনোনীত করতে পারবে। এর ফলে সংসদ সদস্য কেনা বা বিক্রি হওয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না। তিনি বলেন, সুযোগ পেলে যে কেউ নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে কিংবা সুযোগ-সন্ধানীরা নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টা করতেই পারে। সুতরাং নির্বাচনে যাতে কারচুপি হতে না পারে অথবা নির্বাচনে কারচুপি করার মতো পরিবেশ যাতে না থাকে, সেই পদ্ধতি আমরা উদ্ভাবন করতে পারি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির আরও একটি সমস্যার দিক হলো- এ পদ্ধতিতে শতকরা ৫০ ভাগেরও কম ভোট পেয়ে দেখা যাচ্ছে কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলে। যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪০ দশমিক ৮৬ ভাগ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ১৯৩টি। আবার আওয়ামী লীগ ৪০ দশমিক ২১ ভাগ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ৬২টি। বিএনপি জোটের শরিক জামায়াত ৪ দশমিক ২৯ ভাগ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ১৭টি। এ জোট মোট ৪৫ দশমিক ১৫ ভাগ ভোট পেলেও তাদের মোট আসন হয়েছে ২১০টি। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এ ধরনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া সরকার মতায় এসে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা ইচ্ছামতো সংবিধানে কাটাছেঁড়া করে, ইচ্ছামতো সংশোধনী আনে। অথচ গোটা জাতির জন্য যে সংবিধান- তা সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে বদলানোর অধিকার থাকা উচিত নয়।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারের পরিণতি: এরশাদ বলেন, ২০০৬-এ দেখেছি এবং এখনও দেখছি। অথচ ১৯৯১ সালের সরকার কিংবা ১৯৯৬ সালের সরকারের এ ধরনের করুন অবস্থা ছিল না। যদি আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে কোন দলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার বিধান থাকতো- তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির আসন সংখ্যা হতো- ১২১ এবং আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হতো ১২০। সে েেত্র অন্য ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হতো। অভিজ্ঞতা বলে- কোয়ালিশন সরকার সব সময় নমনীয় থাকে। এ ধরনের সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, গ্রিস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল এবং সর্বশেষ জাপান ও তুরস্কেপ্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ প্রণীত ‘সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা দেশে দেশে’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বিশ্বের ৮৬টি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান।
প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি: এরশাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩০০ হবে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সামর্থ্য অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করে নির্বাচন কমিশনে তালিকা পেশ করবে। তালিকার সঙ্গে প্রত্যেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা থাকবে। একই প্রার্থী একাধিক দলের তালিকায় থাকলে তার প্রার্থিতা বাতিল হবে। প্রত্যেক দল নির্ধারিত কোটা অনুসারে প্রার্থী তালিকা তৈরি করবে। প্রার্থী তালিকার কোটা হবে নিম্নরূপ: সাধারণ ৫০ ভাগ, মহিলা ৩০ ভাগ, সংখ্যালঘু ১০ ভাগ, পেশাজীবী ১০ ভাগ। সাধারণ প্রার্থী কোটায় যে কোন প্রার্থী থাকতে পারবেন। পেশাজীবী কোটায় থাকবেন শিক-আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-শ্রমিক নেতৃত্ব। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন দল কোন কোটায় কত আসন লাভ করবে। যে দল সর্বাধিক ভোট পাবে, সে দলই ভগ্নাংশের সুযোগ লাভ করবে। অর্থাৎ কোন দল কাস্টিং ভোটের শতকরা ১ ভাগ ভোট লাভ করলে ৩টি আসন পাবে। ১ দশমিক ৫০ ভাগ থেকে ১ দশমিক ৯৯ ভাগ পর্যন্ত ভোট পেলে ৪টি আসন লাভ করবে। অবশিষ্ট ভগ্নাংশের যোগফলের সুবিধা সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দল ভোগ করবে। নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে কোন আসনে কোন দলের প্রার্থী প্রতিনিধিত্ব করবেন। সে েেত্র দলের প্রাপ্ত ভোটাধিক্য প্রথম বিবেচনা হিসেবে গণ্য করা হবে। কোন দলের প্রতিনিধি মৃত্যুবরণ কিংবা পদত্যাগ করলে অথবা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে সংসদ প্রতিনিধি পদ হারালে ওই আসনে কোন উপনির্বাচন হবে না। সংশ্লিষ্ট দল তাদের প্রার্থী তালিকা থেকে নতুন প্রতিনিধির মনোনয়ন দেবে। নির্বাচন কমিশন তাকেই সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোন দলীয় ভিত্তিতে হবে না। যেমন : ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সেখানে সরাসরি প্রার্থীরাই নির্বাচন করবেন। যে কোন নির্বাচনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাহী মতার অধিকার বলে দায়িত্ব পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে এরশাদ বলেন, আমি আজ এ প্রস্তাব দিলাম। মিডিয়া ও টক শো’র পে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারে। একদিন না একদিন আমাদের এ প্রস্তাবের পইে ফিরে আসতে হবে। তিনি বলেন, সংসদ হতে হবে সর্বদলীয়। এক প্রশ্নে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের কোন আস্থা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিএম কাদের, জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।