মালিকপরে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, শ্রমিকদের কঠোর বাস্তবতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির ৮ হাজার ১১৪ টাকার দাবিতে টানা বিােভে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে তৈরি পোশাকাশিল্প খাত। শ্রমিকদের এ বিােভকে খুব বেশি বাড়াবাড়ি মনে করছে পোশাক শিল্প মালিকরা। একিভাবে শ্রমিকদের খেয়েপরে বেঁচে থাকার আন্দোলনে পুলিশের চড়াও হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র বা সরকারের নগ্নতা প্রকাশ পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রমিক নেতারা।

গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া শ্রমিকরা বিােভ তৃতীয় দিনে সহিংস রূপ নেয়। তাজরীন ফ্যাশনে আগুন তারপর রানাপ্লাজা ধসের পর শ্রমিক বিােভে আবারও গভীর সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্প। রুটি-রুজির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও উচ্ছৃংখল শ্রমিকরা কিছু সার্থবাদী লোকের উসকানি পেয়ে বেপরোয়া ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে দাবি করছেন পোশাক শ্রমিক মালিকরা। গত সোমবার বড় ধরনের সহিংসতা এবং য়তির আশঙ্কায় শত শত পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন মালিকরা।

এর মধ্যে শ্রমিক বিােভ নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো কঠোর অবস্থান ও হুমকি ধামকি দেখিয়েছেন শ্রমিক নেতা নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। যেসব গার্মেন্টস কারখানায় অস্থিরতা চলছে সেখানকার শ্রমিকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে গত সোমবার তিনি বলেন, ‘আগামীকাল থেকে বন্ধ কারখানাগুলোর শ্রমিকদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছি। এরপরও যারা কাজে যাবেন না, তারা আমাদের কেউ না। তারা কারখানা বন্ধের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।’

এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে মহাসমাবেশে শ্রমিক নেতারা শ্রমিকদের পে ৮ হাজার টাকা মজুরি দাবি করলেও তা কৌশলে এড়িয়ে যান সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী মো. শাহাজান খান।

তিনি সমাবেশে বলেন, ‘৬০০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব যৌক্তিক নয়। তবে শ্রমিকদের দাবি ৮ হাজার ১১৪ টাকা এ নিয়ে প্রয়োজনে দর কষাকষি হতে পারে।’ এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তপেও দাবি করেন তিনি। সেসময় সমাবেশে উপস্থিত শ্রমিকরা ৮ হাজার টাকার নিচে মালিক পরে কোনো সিদ্ধান্ত মানবে না বলে বারংবার স্লোগানের মাধ্যমে জানিয়েছে দেন।

এরপর শ্রমিক-মালিক-সরকার দফাদফায় বৈঠক হয়েছে। মালিকপ শ্রমিকদের শান্ত থাকার ও ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ঈদের আগেই বেতন-বোনাস দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। গতকাল শনিবার পোশাক শিল্পের চলমান অস্থিরতা নিরসনের ল্েয পাঁচটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস মেনুফ্যাচারারর্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমইএ)। একইসঙ্গে অবিলম্বে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

অস্থিতিশীলতা নিরসনে তাদের ঘোষিত সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে- পোশাক শিল্প খাত রার জন্য মালিক শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে; অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী বহিরাগতদের প্রতিহত করতে এবং গুজব ছড়িয়ে যারা এ খাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে সরকারকে অনুরোধ জানানো হবে; যতো শিগগির সম্ভব মজুরিবোর্ডকে যৌক্তিক মজুরি ঘোষণা করতে অনুরোধ জানানো ও ঈদের আগে শ্রমিকদের সব বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হবে।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘শ্রমিকরা আট হজার টাকার যে দাবি করছে, তা বাঁচামতো মজুরি বলতে যা বুঝায় তার চাইতে অনেক কম এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখন শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। এ আন্দোলনে কে উসকানি দিচ্ছে? মালিক বলছে শ্রমিক! শ্রমিক বলছে মালিক! আমার মনে হচ্ছে কারখানা মালিক নিজেরাই এ উসকানি দিচ্ছে। কারণ তারা শ্রমিকদের এ দাবি মেনে নিলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। আর একটা বিষয় হলো, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা। যদি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন থাকতো তাহেলে এসব ভাঙচুর হতো না। মালিকদের উচিৎ দ্রুত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়া।’

শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম পথিক বাংলামেইলকে বলেন, ‘শ্রমিকরা কারখানা ভাঙতে পারে না। তবে গার্মেন্ট শ্রমিকরা দীর্ঘদিন থেকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। অত্যাচার সহ্য করতে করতে তাদের মধ্য এক চাপা ােভ দেখা দিয়েছে। শ্রমিক যখন ৮ হাজার টাকার কথা বলছে তখন পুলিশ মালিকদের প নিয়ে শ্রমিকদের ওপর হামলা করাটা রাষ্ট্রের বা সরকারের নগ্ন চরিত্রের প্রকাশ পাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘একজন শ্রমিককে ৪০ টাকায় বেগুন, ৫০ টাকায় কাঁচা মরিচ ও ১০০ টাকায় পিঁয়াজ কিনে খেতে হচ্ছে। শ্রমিকদের যদি মালিকপ ৩ হাজাচর ৬০০ টাকা দেয় তাতে ৪ জনের সংসার চলবে না।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএ এবং এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, ‘সরকারের এখনো সময় রয়েছে। সরকারতো চলে যায়নি বা মালিকরা কারখানা বন্ধ করে চলে যাননি। শ্রমিক নেতারা যে দাবি করেছেন তা হুট করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদ্যমান শ্রম আইনের কিছু জটিলতা রয়েছে তা ঠিক না করে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। আলোচনার মাধ্যমে এর একটি সমঝোতা করা যাবে। কিন্তু এ কাজটি না করে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও করাটা খুব বাড়া বাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের উল্লেখযোগ্য ১০টি শিল্প খাতের মধ্যে পোশাকশ্রমিকের মজুরিই সবচেয়ে কম। অথচ পোশাক খাত থেকেই দেশের ৭৮ ভাগ রপ্তানি আয় হয়।
২০১০-১২ সালে গঠিত বিভিন্ন শিল্প শ্রমিকের জন্য গঠিত ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে ঘোষিত মজুরি হিসেবে বর্তমানে নির্মাণশিল্প ও কাঠমিস্ত্রি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৮২ টাকা। ট্যানারি শ্রমিকের ৯ হাজার ৩০০ টাকা। তেল মিলের শ্রমিদের ৭ হাজার ৪২০ টাকা। ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহনে ৬ হাজার ৩০০ টাকা, রি-রোলিং মিলে ৬ হাজার ১০০ টাকা, কোল্ড স্টোরেজে ৬ হাজার ৫০ টাকা, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেটস কারখানায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা।

এছাড়া ধানভাঙা চাতালে আধা দ শ্রমিকের মজুরিও বর্তমানে ৭ হাজার ১৪০ টাকা। সল্ট (লবণ) ক্রাশিং শিল্পে মজুরি ঘণ্টায় ২৬৫ টাকা। কিন্তু পোশাকশিল্পে মজুরি হচ্ছে মাত্র ৩০০০ হাজার টাকা। আর মালিক প একে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।

মানব সভ্যতার শুরু থেকে একটি শ্রেণী শোষিত হয়ে আসছে আর তা হলো, শ্রমিক শ্রেণী। দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ, বুর্জোয়া সমাজের পরে পুঁজিবাদি সমাজে এসে এ শ্রেণীর ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু হয়। এর পরিপেেিত ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যায্য দাবিতে (উন্নত কর্মপরিবেশ, নির্ধারিত নিয়ম ও ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ) বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছেন, ফাঁসিতে ঝুলেতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করলেও তা রাজনৈতিক অজুহাতে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শ্রমিকরা এখনো তাদের ন্যায্য অধীকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দেশে শ্রমিক ইউনিয়ন না থাকায় অকারণে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। যারা চাকরি ছাটাইয়ের প্রতিবাদ করতে যায় তাদেরকেও চাকরি থেকে অনেক েেত্র বাদ দেয়া হচ্ছে।

তাজরীন, রানাপ্লাজায় হাজার হাজার শ্রমিক প্রাণ দিয়েছে। ১৮৮৬ সালের শিকাগো আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম দাবি আদায় করতে পারলেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা আজো তাদের ন্যূনতম মজুরির অধিকার পাচ্ছে না। শ্রমিকপ ৮ হাজার ১১৪ টাকা দাবি করে এলেও তা মানছে না মালিক প। তারা বাড়িয়েছে মাত্র ৬০০ টাকা। তা মেনে নিতে পারছে না শ্রমিকরা। দাবি আদায়ে দিনের পর দিন বিােভ করলেও তাতে কান দিচ্ছে না কেউ। উল্টো শ্রমিকদের ওপর চালানো হচ্ছে পুলিশি নির্যাতন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫