স্টাফ রিপোর্টার ॥ লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ট্রান্সমিশন ব্যবসা। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) টেলিযোগাযোগ আইনের কোনরূপ তোয়াক্কা করছে না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বারবার বিটিআরসিকে পত্র দিয়ে বিষয়টি বিধিসম্মত নয় বলে সতর্ক করে দিলেও, তা আমলে নিচ্ছে না বিটিআরসি। এমনকি আদালতের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিটিআরসি’র প থেকে লাইসেন্স ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানকে ট্রান্সমিশন ব্যবসা করার অবারিত সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয় এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিটিআরসি’র একটি মহল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাংলাফোন লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে ট্রান্সমিশন ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে। অবৈধ ভিওআইপি কারবারীদের যোগসাজশে ওই মহলটি বিটিআরসি’র কমিশন সভার সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে বেআইনী এই কাজ করে চলেছে দিনের পর দিন। অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিশন সেবা দিতে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স নেয়ার বিধান রয়েছে। অথচ ফিক্সড ফোন ও ইন্টারনেটসেবার লাইসেন্স নিয়েই সেবাটি দিচ্ছে বাংলাফোন লিমিটেড। এটা দেশের টেলিযোগাযোগ আইন ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালার লঙ্ঘন।
টেলিকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ বাস্তবায়নের ল্েয দেশজুড়ে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির জন্য দু’টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন্স ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের ক্যাবল ও সেবাসমূহ এনএমসি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিংয়ের আওতায় রয়েছে। কিন্তু বাংলাফোন নামের একটি প্রতিষ্ঠান এনটিটিএন লাইসেন্স ছাড়াই অপটিক্যাল ফাইবার নির্মাণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর, আইএসপিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লীজ দিয়ে ব্যবসা করছে। এনটিটিএন লাইসেন্সবিহীন হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কও মনিটরিংয়ের আওতায় নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মনিটরিং বিহীন এই নেটওয়ার্ক নিয়ে অবৈধ ভিওআইপি কারবারীদের রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। বছরে প্রায় ১০-১২ হাজার কোটি টাকার অবৈধ কলটার্মিনেশন হচ্ছে অবৈধ এই বেআইনী নেটওয়ার্ক দিয়ে। অন্যদিকে এ খাতে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিপুল পরিমাণ আর্থিক তির শিকার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপো করে বিটিআরসি গত ৫ বছর যাবৎ এনটিটিএন লাইসেন্স ছাড়াই বাংলাফোনকে ট্রান্সমিশন ব্যবসার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিটিআরসি’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আইএসপি লাইসেন্সের আওতায় বাংলাফোন লিমিটেড অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরী করেছে। বিটিআরসি’র অনুমোদন সাপেে তারা ট্রান্সমিশন ব্যবসা করছে। এনটিটিএন লাইসেন্স ছাড়াই নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, রণাবেণ এবং ভাড়ার ব্যবসা করা যায় কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাফোনের আবেদনের প্রেেিত তাদের এনটিটিএন লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এনটিটিএন লাইসেন্স ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানের ট্রান্সমিশন ব্যবসা করা বেআইনী। বাংলাফোন লাইসেন্স ছাড়া কিভাবে অবলীলায় ৫ বছর ধরে ট্রান্সমিশন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে- সে বিষয়ে বিটিআরসি’র নিকট জানতে চাওয়া হয়েছে। তাছাড়া লাইসেন্স অনুমোদন বা পারমিট দেয়ার এখতিয়ার একমাত্র সরকারের। টেলিযোগাযোগ নীতিমালায় সরকার বলতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বোঝানো হয়েছে।
অবৈধ ট্রান্সমিশন-এর বিষয়ে বিটিআরসি’র এক পত্রের পরিপ্রেেিত গত ১৮ জুন বিটিআরসি চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নাফিউল হাসান স্বারিত এক পত্রে, বিভিন্ন গাইডলাইনের বিধানাবলীর আলোকে এবং বিটিআরসি কর্তৃক ইতোপূর্বে এ বিষয়ে জারীকৃত নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় এনটিটিএন লাইসেন্স ব্যতীত ট্রান্সমিশন সেবা প্রদানের সুযোগ/অনুমতি প্রদান না করা এবং এরূপ কোন পারমিট প্রদান বা মেয়াদ বৃদ্ধির েেত্র টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ৪০ ধারার বিধান মোতাবেক সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। গত ৭ আগস্ট উপ-সচিব নাফিউল হাসান স্বারিত অপর এক পত্রে বলা হয়, বাংলাফোন লিমিটেডকে ট্রান্সমিশন সেবা প্রদানের পারমিটের মেয়াদ বৃদ্ধি বিধি সম্মতভাবে করা হয় নি। বিটিআরসি কর্তৃক বাংলাফোন লিমিটেড বরাবর ইস্যুকৃত পারমিটের বিষয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয় ওই পত্রে।
এদিকে সম্প্রতি এনটিটিএন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলি বাংলাফোন লিমিটেডকে অবৈধভাবে ট্রান্সমিশন ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছেন মন্ত্রণালয়ে। এতে জানানো হয়, ট্রান্সমিশন ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে কেবলমাত্র দুইটি কোম্পানীকে এনটিটিএন লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এ দু’টি কোম্পানী হলো ফাইবার @ হোম লিমিটেড এবং সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড। লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী এনটিটিএন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের ট্রান্সমিশন তৈরী করা, রণাবেণ করা, উন্নয়ন করা, অপারেট করা, অন্যকোন প্রতিষ্ঠানের নিকট ভাড়া প্রদান করা, টেলিকম আইন, এনটিটিএন লাইসেন্সিং গাইডলাইন এবং ইনফ্রাস্ট্র্রাকচার শেয়ারিং গাইড লাইনের পরিপন্থী। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাফোন বিটিআরসি-এর কাছ থেকে দফায় দফায় পারমিট সুবিধা নিয়ে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। লাইসেন্স ছাড়া পারমিট-এর মাধ্যমে বাংলাফোন লিমিটেডকে অবৈধভাবে ট্রান্সমিশন ব্যবসার সুযোগ দেওয়ায় এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের তির শিকার হচ্ছে। কারণ, ট্রান্সমিশন ব্যবসা ছাড়া এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্য কোন ব্যবসা নেই। এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে বিপুল অংকের টাকা লাইসেন্স ফি (টাকা ৩ কোটি) পিজিবি (পারফরমেন্স ব্যাংক গ্যারান্টি- টাকা ১০ কোটি) জমা দিয়ে লাইসেন্স গ্রহণ করেছে এবং লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী সারা দেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য যে বাধ্যবাধকতা (রুল আউট ওবলিগেশন) রয়েছে তা পূরণ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোপূর্বে সরকার ও বিটিআরসিকে বারবার অনুরোধ জানিয়ে আসছে যে, আইনের বাধা-নিষেধ উপো করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এবং বাংলাফোন লি.কে এনটিটিএন ব্যবসা পারমিট দেওয়ার ফলে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো তিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালনা ও সেবা প্রদানের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেহেতু এনটিটিএন লাইসেন্সকারীদের কোন লাইসেন্স ফি, পিজিবি এমনকি রেভেনিউ শেয়ারিং ব্যতীত ট্রান্সমিশন ব্যবসার জন্য অবৈধভাবে পারমিট দেওয়া হচ্ছে। ফলে এনটিটিএন অপারেটররা কোনভাবেই তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। এ জন্য অন্যান্য অপারেটররা এনটিটিএন অপারেটরদের কাছে না এসে অবৈধভাবে বাংলাফোনের কাছে যাচ্ছে। কারণ, এটা তাদের প্রধান ব্যবসা না।
পারমিট দেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ (২০১০ সালে সংশোধিত) এর ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, কোন পরিচালনাকারী, কমিশন কর্তৃক ইস্যুকৃত পারমিট ব্যতীত, তাহার লাইসেন্সকৃত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বা সেবা প্রদানের কোন স্থাপনা, যন্ত্রপাতি বা সুবিধা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বা ফিস বা অন্য কোন ধরনের মূল্য বা সুবিধা প্রাপ্তির বিনিময়ে অন্য কোন ব্যক্তিকে ব্যবহারের অনুমতি বা সুযোগ প্রদান করিবে না। উপধারা (১) এ উল্লেখিত অনুমতি লাভের উদ্দেশ্যে, পরিচালনাকারী কমিশনের নিকট কোন আবেদন করিলে, কমিশন, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানপূর্বক একটি প্রতিবেদন সরকারের নিকট পেশ করিবে এবং সরকার উক্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, আবেদনকৃত অনুমতি প্রদত্ত হইলে লাইসেন্সকৃত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালনা ও সেবা প্রদানের উপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না তাহা হইলে, উক্ত আবেদন মঞ্জুর করিবার সিদ্ধান্ত প্রদান করিবে এবং কমিশনে তদানুসারে নির্ধারিত মেয়াদের জন্য তৎকর্তৃক নির্ধারিত শর্তে পারমিট ইস্যু করিবে।
অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয় এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিটিআরসি’র একটি মহল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাংলাফোন লিমিটেডকে অবৈধভাবে ট্রান্সমিশন ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে। সম্প্রতি বিটিআরসি’র ১৫৮তম কমিশন সভায় বাংলাফোন লিমিটেড এর বিষয়ে বলা হয়, ২০০৪ সালে বাংলাফোনকে ২০ বছরের জন্য পিএসটিএন সেবার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়। কমিশনের অনুমতি ব্যতিরেকে অবৈধভাবে অপটিক্যাল ফাইবার লীজ দেয়ার কারণে কেন বাংলাফোন লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না মর্মে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, অপটিক্যাল ফাইবার লীজ দেয়ার বিষয়ে দায়েরকৃত রীট পিটিশনের শুনানী অন্তে এই মর্মে রায় প্রদান করেন যে, বাংলাফোন কর্তৃক অপটিক্যাল ফাইবার লীজ দেয়া অবৈধ ও বেআইনী। তৎপ্রেেিত কমিশন অপটিক্যাল ফাইবার ভাড়া গ্রহণকারীদের বাংলাফোন থেকে অপটিক্যাল ফাইবার লীজ না নেয়ার জন্য পত্র প্রেরণ করা হয়। উক্ত পত্রকে খ-ন করে দায়েরকৃত রীট পিটিশন-এ বাংলাফোন কর্তৃক অপটিক্যাল ফাইবার লীজ দেয়া অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করেন এবং আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কারণে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক বাংলাফোন কর্তৃক অপটিক্যাল ফাইবার লীজ দেয়া অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা বহাল রয়েছে।