ছাত্রলীগের ১০ নেতা “শিা-ব্যবসায়”

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিা-ব্যবসার’ সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কমিটির নেতারা। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তত ১০ জন নেতা। ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে বিরোধ আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়েও নেপথ্যে থেকে কোনো কোনো নেতা সেগুলোর বর্তমান প্রশাসনকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছেন।

এই তালিকায় আছেন ছাত্রলীগের সাবেক তিন সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম, বাহাদুর বেপারী ও লিয়াকত শিকদার। আছেন সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী এবং সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান ওরফে শিখর। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামানও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হয়েছেন। এর বাইরে সংগঠনের অন্যান্য পদে থাকা কয়েকজন নেতাও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হয়েছেন।

শিা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সূত্র জানায়, এই সরকারের সময়ে ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭১। দলীয় বিবেচনায় নতুন করে আরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে। এখানেও আছেন ছাত্রলীগের নেতারা।

অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা না করে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে দলীয় ব্যক্তিদের কার্যত ‘ব্যবসার’ সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।

আইন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা। কিন্তু শিা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ শিাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু থেকেই কার্যত লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা বিভিন্নভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। এ জন্যই যোগ্য-অযোগ্য সবাই এই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ‘লাভজনক ব্যবসা’ বলেই নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শতাধিক আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে আছে।

বর্তমানে ৭১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০-১২টি ছাড়া বাকিগুলো ভালোভাবে চলছে না। অনেকগুলোর বিরুদ্ধে সনদ ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগ আছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডে স্রেফ পরিবারের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে পারিবারিক ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করেছেন।

শিা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে জানা যায়, এই সরকারের আমলে অনুমোদন দেওয়া সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি হিসেবে আছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংসদ নজরুল ইসলাম। মহাজোট সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলামও ট্রাস্টি সদস্য হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। এই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের স্ত্রী। সদস্য হিসেবে আছেন শিা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন হাফিজুর রহমান খান। তবে এর নেপথ্যে আছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুজ্জামান ওরফে শিখর।

সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার বিরোধপূর্ণ অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরও ট্রাস্টি সদস্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ট্রাস্টি সদস্য ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি গোলাম সারোয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ইকবাল হোসেন। বোর্ডের সভাপতি সরকারি দলের সাংসদ ইসরাফিল আলম।

অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মালিকানায় ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যও ছিলেন। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আবুল হোসেন শিকদারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর জের ধরে আবুল হোসেন শিকদারের প হয়ে ছাত্রলীগের নেতারা ট্রাস্টি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হন।

চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম। এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান জহির আহম্মেদ। বোর্ডের সদস্য হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান ওরফে শিখর, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী ও ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজেরও সদস্য।

বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরে সঙ্গেও ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতিসহ কয়েকজন সাবেক নেতা জড়িত আছেন বলে অভিযোগ আছে।

ফেনী ইউনিভার্সিটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অন্যতম সদস্য হলেন বিগত মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওরফে আলাউদ্দিন নাসিম। মূলত তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুমোদন পাওয়ার েেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে শিা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনিও একসময় ছাত্রলীগ করতেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার বলেন, ‘শিা ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া অনেক কিছু করার থাকলেও শিার সঙ্গে থাকাকে অধিক সম্মানের বিষয় বলে মনে করি।’

নতুন আরও সাত বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাচ্ছে: শিা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে শিা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রণদা প্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটি ছাড়া বাকি ছয়টির পেছনেই সরকার-সমর্থক ব্যক্তিরা আছেন।

প্রস্তাবিত নাটোরের রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা (আবেদনকারী) হিসেবে আজিজুর রহমান হলেও এর পেছনে আছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারী। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাহাদুর বেপারী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমে রাজশাহীতে করার জন্য আবেদন করা হয়। পরে জায়গা স্থানান্তরের আবেদন করা হয়।

ঢাকার ফারইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় আছেন প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় (সম্পর্কে চাচা হন) শেখ কবির হোসেন, ঝালকাঠির গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ছাড়াও একজন প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী সৈয়দা আরজুমান বানু। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমে রাজশাহীর জন্য আবেদন করলেও পরে জায়গা পরিবর্তন করে। জামালপুরের শেখ ফজিলাতুননেসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে সহিদুর রহমান খানের নাম থাকলেও এর সঙ্গে আছেন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সরকারি দলের হুইপ মির্জা আজম। রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী সাবেক উপাচার্য আবদুল খালেকের স্ত্রী অধ্যাপিকা রাশেদা খালেক। কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গেও আছেন সালাউদ্দিন আহমেদ, মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন।

জানতে চাইলে শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা যোগ্য ও যেখানে প্রয়োজন, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

তবে শিা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তেই দলীয় ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়া হচ্ছে।

আগেরগুলোর মালিকানায় যাঁরা: এই সরকারের আমলে অনুমোদিত ঢাকার ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন আওয়ামী উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সিলেটের গোলাপগঞ্জের নর্থইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল আহমেদ চৌধুরী।

চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান হলেন ওই এলাকার সরকারদলীয় সাংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার। এর সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও আছেন বলে জানা গেছে। তবে কাগজপত্রে এখনো তাঁর নাম নেই।

গত বছরের অক্টোবরে আলাদাভাবে অনুমোদন পাওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আছেন এক্সিম ব্যাংকের মালিকেরা। তাঁদের সঙ্গে আছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুল মান্নান।

এর আগে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও দলীয় বিবেচনায় বেশ কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক ব্যক্তিরাও বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছেন। এমনকি ওই জোট সরকারের শেষ কর্মদিবসেও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫