স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষায় দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে কৌশলের এ লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সাংগঠনিক তৎপরতা, কূটনীতি, জোটের কলেবর বৃদ্ধি, শক্তি প্রদর্শন, এমনকি প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রেও।
পর্যবেক্ষকদের মতে, বড় দুটি দলের শীর্ষ নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেও স্নায়ুযুদ্ধের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, সংবিধানের বাইরে একচুলও নড়বেন না। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া বলছেন, চুল উড়ে দিশেহারা হয়ে যাবেন। কৌশলের লড়াইয়ে কেউ হারতে চাইছেন না। চাইছে না নির্বাচনের আগেই নৈতিক পরাজয় ঘটে এমন কোনো বার্তা জনগণ ও নেতাকর্মীদের দিতে। ফলে উভয় দলই ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় দুটি দলের কৌশলের এ লড়াইকে ‘ওয়ার অব নার্ভস’ বলে অভিহিত করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ। তার মতে, অস্তিত্ব রক্ষা ও নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতেই বড় দুটি দল অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছে। তবে জনগণ কীভাবে সাড়া দেয় তার ওপর নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত কে জয় লাভ করবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও এ পরিস্থিতিকে বড় দুটি দলের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে চরম আস্থাহীনতার কারণে আজকের এই সংকট তৈরি হয়েছে। দুই দলই জনমত পক্ষে নিতে মরিয়া। অথচ আগামী নির্বাচন কাঠামো ঠিক হয়নি। এই কাঠামো কী হয় তার ওপর দুই দলের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। ফলে নিজেদের মতামতকে টিকিয়ে রাখতে দল দুটি মরিয়া হয়ে উঠছে।
চাপে রাখার কৌশল : নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে চাপে রাখতে চাইছে। বিএনপির উদ্দেশ্য হল আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো পরিবর্তন করে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করা। আর এ জন্য নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে দলটি এগুচ্ছে। ওদিকে নির্বাচনের আগে চাপমুক্ত থাকতে চাইছে সরকারি দল। এ জন্য বিরোধী দলের দাবির কাছে তারা নতি স্বীকার করতে চাইছে না। তাই বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি দলীয় তথা সাংগঠনিক কর্মসূচি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। উদ্দেশ্য হল নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখা। এছাড়া মামলা-মোকদ্দমা সচল করেও বিরোধী দলের নেতাদের চাপে রাখতে চায় সরকার। উদ্দেশ্য হল- সর্বশক্তি নিয়ে তারা যাতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে।
চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৮টি স্থানে জনসভা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার। এছাড়া আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সাংগঠনিক সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। পক্ষান্তরে আগামী দুই মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৮টি জনসভার কর্মসূচি রয়েছে খালেদা জিয়ার। এছাড়া আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাংগঠনিক সফর রয়েছে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট নেতাদের।
সূত্র মতে, ঈদুল আজহার আগে এসব কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেবে বিএনপি। এরপর সরকারের মেয়াদের শেষভাগে দাবি আদায়ে দলটি কঠোর আন্দোলনে যাবে। সূত্র মতে, উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর অনুরোধে সরকারের মেয়াদ শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে দেবে বিরোধী দল। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোভাব বিবেচনায় নিয়ে চলছে বিএনপি। ফলে মেয়াদ শেষের আগে তারা ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে যাবে না।
কূটনৈতিক যোগাযোগ : বাংলাদেশের বাস্তবতায় শুধু জনমতের ওপর নির্ভর করতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে দেশ ও দেশের বাইরের কথিত ‘ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্রগুলো’কেও এজন্য তারা পক্ষে নিতে চায়। দল দুটির অধিকাংশ নীতি-নির্ধারক নেতা মনে করেন, স্বাধীনতার পর সবগুলো সরকারের ক্ষমতায় আসার নেপথ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর নেপথ্য ভূমিকা আছে। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘ ‘বৈধতা’ না দিলে নির্বাচন সমর্থনযোগ্যও হয় না। ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় দুটি দলের নেতারা বাংলাদেশস্থ কূটনীতিকদের পাশাপাশি অন্য দেশেরও দ্বারস্থ হচ্ছেন। ভারতের সঙ্গে মহাজোট সরকারের সুসম্পর্কের কথা বিবেচনায় রেখেও গত বছর অক্টোবর মাসে সে দেশ সফর করেছেন খালেদা জিয়া। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনমতের কারণে ভারত তার অবস্থানে ‘অনড়’ থাকবে এমন নয়। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে সরকারের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে ওই সব দেশের মন গলাতে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কিছুদিন আগে দেশটির বাংলাদেশস্থ দূতাবাসে ইফতার পার্টিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশস্থ কূটনৈতিক মিশনগুলোর কর্তাব্যক্তিদের পক্ষে নিতে প্রায় প্রতিদিনই বড় দুটি দলের পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি ‘ব্রিফ’ করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- বিরোধী দলগুলো হরতালসহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ কথিত মৌলবাদীদের হাতে চলে যাবে বলেও তাদের কাছে আশংকা ব্যক্ত করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হল- পশ্চিমা বিশ্ব যেন বিএনপিকে সমর্থন না করে। এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের মানবাধিকার লংঘন ও দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলে কিছুই থাকবে না।
সূত্র মতে, বড় দুটি দলের নেতারাই পরস্পরবিরোধী কূটনৈতিক মিশন নিয়ে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। কিছু কিছু দেশে লবিস্টও নিয়োগ করা হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে।
মেরুকরণ : সমমনা দলগুলোকে পক্ষে নিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণেও কোনো দল পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। এ জন্য আওয়ামী লীগ মহাজোটভুক্ত দলগুলোকে পক্ষে রাখার পাশাপাশি বিএনপির নেতৃত্বে যাতে বড় আর কোনো দল জোটবদ্ধ না হয় সেদিকে নজর রাখছে। এক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কোনো কোনো বিশ্লেষক জামায়াতের সঙ্গে গোপন সমঝোতা প্রচেষ্টার বিষয়ে সরকারের দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তুলছেন। এছাড়া প্রগতিশীল দলগুলোকেও তারা যে কোনো মূল্যে পক্ষে রাখতে চায়। আবার বিকল্প ধারা, জেএসডি, গণফোরাম, কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগসহ অন্য দলগুলো যাতে বিএনপির পক্ষে না যায় এ নিয়েও তৎপরতা চালাচ্ছে।
এদিকে নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে সরকারকে একঘরে করতে হবে বলে মনে করে বিএনপি। এ জন্য যতদূর পারা যায়, মহাজোটের বাইরে থাকা দলগুলোকে তারা জোটে নেয়ার পক্ষপাতী। ইতিমধ্যে অনেকগুলো দলের সঙ্গে তাদের ‘কথা’ হয়েছে। সরকারের শেষ দিকে ওই দলগুলো বিএনপির পক্ষে জোট গঠনের ঘোষণা দেবে। পাশাপাশি নানামুখী চাপ সত্ত্বেও শরিক জামায়াতকে ঠেলে জোটের বাইরে দিতে চায় না বিএনপি। এছাড়া এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির একাংশের সঙ্গে বিএনপির গোপনে আলাপ-আলোচনা চলছে। ক্ষমতার শেষভাগে রাজনৈতিক মেরুকরণের অনেক কিছুই স্পষ্ট হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।