টঙ্গী প্রতিনিধি ॥ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদ বেপরোয়া দখল ও বর্জ্যের কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। তুরাগ নদ এবং বালু নদীর মিলনস্থলের কয়েক কিলোমিটার এলাকা অর্থাৎ বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ শিল্প শহর টঙ্গীকে বুকে আগলে নিয়ে বয়ে চলা স্থানটিই কহর দরিয়া। যা কালের বিবর্তনে পুরোটাই তুরাগ হয়ে গেছে।
তুরাগ কহর দরিয়া ও বালু নদী এককালে খরস্রোতা ছিল। ছিল শত প্রকারের মাছের চারণভূমি। বুকচিরে পালতোলা নৌকা চলতো। আয়নার মতো স্বচ্ছ পানি ছিল। দখলবাজ ও প্রভাবশালীরা নদী দখল করে ইট, বালু, সুরকি, পাথর, সিমেন্ট বিক্রির ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলছে। নদী এবং বিঘার পর বিঘা খাস জলাশয় ভরাট করে বড় বড় অট্টালিকা, কারখানা, হাউজিং এস্টেট ও মার্কেট গড়ে উঠেছে। ভূমিদস্যুদের থাবায় নদী ও জলাশয়গুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তারপরও নদের যেটুকু রেখা আছে তা গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কারখানার বর্জ্যে দূষিত হয়ে গেছে। মৎস্য সম্পদও প্রায় বিলুপ্ত। দখল ঠেকাতে সরকার বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দখলদারদের রাজনৈতিক পরিচয় ও বিত্তভৈববের কাছে হেরে যাচ্ছে।
কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগের দু’পাশই এখন প্রভাবশালীদের দখলে। প্রভাবশালীদের মধ্যে রাজনৈতিক (!) ব্যক্তিত্ব ও শিল্পপতি অন্যতম। কখনো কখনো ভূমি জরিপ চালিয়ে নদী ও জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণে সরকার প্রভাবশালীদের বাধার সম্মুখীন হন। কোথাও কোথাও সীমানা পিলার (রড সিমেন্টের) পুঁতেও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব প্রভাবশালী ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় নকল দলিলসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে স্থায়ীভাবে দখল করে নিচ্ছে। নদী পাড়ের বেশ কিছু জায়গা নিয়ে মামলাও চলছে। দখলের কারণে নদ শীর্ণকায় হয়ে গেছে। নদী নাব্য হারিয়ে বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমার সময় আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু দখলদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় কিছুদিন পর আবারো অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে। কোথাও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রভাবশালীরা তা মানছে না। বিশ্ব ইজতেমা মাঠের পশ্চিমে তুরাগ নদের পশ্চিম তীরের অধিকাংশ জায়গা গজারি গাছ ও বাঁশের খুঁটি গেড়ে মাটি ভরাট এবং টঙ্গী-তুরাগ সংযোগ সড়ক ব্রিজের উত্তর দিকেও একই কায়দায় ঘেরা দিয়ে দখল করায় নদ এখন অতি শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। নদীর পূর্ব তীর ভাঙছে। ফলে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান আরো ছোট হয়ে পড়ছে। ইজতেমার সময় লাখো মুসল্লি নষ্ট পানিতে অজু-গোসল করতে পারছেন না। দুর্গন্ধে দেশি-বিদেশি মুসলিদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
রাজধানীর চারপাশ দিয়ে নৌপথ অর্থাৎ নৌবাস সার্ভিস চালুর লক্ষ্যে বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নদী খনন করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদ ও খননকাজ সম্পূর্ণ করতে না পাড়ায় তুরাগ নদ ও বালু নদী অর্থাৎ রাজধানীর উত্তর ও পূর্ব সীমানা দিয়ে নৌপথ চলু করা সম্ভব হয়নি। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তুরাগ পাড়ের টঙ্গী বাজার এলাকা অর্থাৎ মহাসড়কের টঙ্গী ব্রিজ থেকে পূর্বে রেলব্রিজ পর্যন্ত ১ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বাজারের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি দূষিত ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভরাট হওয়া জায়গা দখল করে প্রভাবশালীরা স্থায়ী-অস্থায়ী মার্কেট, দোকানপাট গড়ে তুলছে। টঙ্গী বাজার মসজিদের দক্ষিণ পাশে মার্কেটের পূর্বে মাছ ও কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার গড়ে উঠেছে। নদীর দক্ষিণ পাড়ে বেশ কিছু জায়গা দখল করে একটি ডাইং ফ্যাক্টরি ও পূর্বে আইচি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। এর মাঝের জায়গায় বালু ব্যবসায়ীরা দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া শিল্পনগরীর বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য বিশেষ করে গার্মেন্ট ও ডাইং কারখানার কেমিক্যাল মেশানো রঙিন পানি সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত নদ দূষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বর্ষা মৌসুমেও নদীর পানি ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ছে। নদীর পানি দূষিত ও ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এখন টঙ্গী বাজারেরও সেই জৌলুসও নেই।
তুরাগ তীরের গ্রাম টঙ্গী ভরান, আরিচপুর, পাগাড়, মাছিমপুর, কাঁঠালদিয়া, দেওড়া, মুদাফা, তিলারগাতী, গোশুলিয়া, সাতাইশ এবং উত্তরার আব্দুল্লাহপুর, কোটবাড়ি এবং তুরাগ থানার দৌড় ও কামারপাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, দখল ও বর্জ্য ফেলার কারণে নদের এ দুরবস্থা হয়েছে। টঙ্গীর দক্ষিণ-পূর্ব এবং রাজধানীর উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে চলা বালু নদীটিও দখলের কারণে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।