বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত ৩৬ কোম্পানির শেয়ার কিনে বিপাকে পড়েছেন হাজারো বিনিয়োগকারি। দীর্ঘ সময় ধরে তালিকাচ্যুতি কিংবা ব্যবসা গুটিয়ে গেলে ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের টাকা ফিরে পাওয়ায় সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারিরা। এতে আইপিওর ফেস ব্যালুর হিসাবে এ ৩৬ কোম্পানির শেয়ারে আটকে আছে বিনিয়োগকারীদের ১৩১ কোটি টাকা।
নিবন্ধনের পর নানা অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে এসব কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। তালিকাচ্যুতির দুই দশকেও এসব কোম্পানি বাজারে ফিরতে পারেনি। তালিকাচ্যুতিতে জবাবদিহিতারও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই ডিএসই’র আইনে। ফলে এ নিয়ে নিস্ক্রিয় ডিএসই কর্তৃপক্ষও।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, অনিয়মের অভিযোগে ১৯৯৪ সালে প্রথম তালিকাচ্যুত করা হয় চাঁদ টেক্সটাইলকে। ২০১৪ সালে তালিকাচ্যুতির এ নথিতে সর্বশেষ যুক্ত হয় ইএল ক্যামিলিয়া। এনিয়ে অনিয়মের অভিযোগে ডিএসইতে তালিকাচ্যুত কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬-এ।
এ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘তালিকাচ্যুতি হওয়া মানে কোম্পানিগুলো টাকা নিয়ে নিরাপদে চলে গেছে। তালিকাচ্যুতির আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিল বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত নিশ্চিত করা।’
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহকারী ৩৬ টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারন বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৩১ কোটি ৩৬ লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা। এ অর্থ শুধু প্রতিটি শেয়ারের ফেস ভ্যালুর উপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়েছে।প্রকৃত অর্থের পরিমাণ আরও বেশি বলে জানিয়েছেন ডিএসই। তবে ফেসভ্যাল্যুর ওপর কোন কোম্পানি কত শতাংশ প্রিমিয়াম নিয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারেনি ডিএসই।
বাজারে তালিকাভূক্তিরপর নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে অর্থিক দুর্নীতি, নিয়মিত লোকসান এবং ব্যাংক লোনে জর্জরিত হয়ে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদন বন্ধ থাকার পরও কোম্পানির শেয়ার নিয়ে চলে কারসাজি। ওঠানামা করে শেয়ারের দর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারন বিনিয়োগকারীরা। এসব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করে ডিএসসি।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘পুঁজিবাজার থেকে কোন কোম্পানি তালিকাচ্যুত হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবে কোম্পানি যদি অবলুপ্ত হয় তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝে নিতে পারেন। কিন্তু বিদ্যমান কোম্পানি আইনে কোন কোম্পানি অবলুপ্ত হওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ। ফলে তালিকচ্যুতির পর অবলুপ্ত হওয়ার নজির নেই। তবে কোম্পানির অবলুপ্তির পদ্ধতি সহজ করা দরকার। তাহলে কোন কোম্পানি তালিকাচ্যুত হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ অনেকাংশে সুরক্ষিত থাকবে।’
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানি অবলুপ্ত হলে শেয়ারহোল্ডারদের দায়-দেনা মিটিয়ে দিতে পরিচালনা পর্ষদ বাধ্য থাকবে। না দিলে আদালতে যেতে পারবে বিনিয়োগকারীরা।
যেসব কোম্পানি তালিকাচ্যুত হয়েছে সেগুলো হলো: চাঁদ টেক্সটাইল, চাঁদ স্পিনিং, ডেল্টা জুট, গসিয়া জুট, প্যানথার স্টিল, আনোয়ারা জুট, স্পেশালাইজড জুট, সমশের জুট, পেপার কনভারটিং, হাওলাদার পিভিসি, এ্যারোমা টি, ফ্রগলেস, সোয়ান টেক্সটাইল, পি.পি.আই, মিলিয়ন ট্যানারী, নিউ ঢাকা রেফ্রিজারেটর, আহাদ জুট মিল, ইসলামি জুট মিলস লিমিটেড, হাইস্পিড শীপ, মিউচুয়াল জুট স্পিনার্স, বেঙ্গল স্টিল, করিম পাইপ, এবি বিস্কুট, ঢাকা ভেজিটেবল, প্যারাগন লেদার, রূপন অয়েল, ন্যাশনাল অক্সিজেন, এসটিএম (ওআরডি), জেম নিটও্য়্যার, জেএইচ কেমিক্যাল, মার্ক বাংলাদেশ, টেক্সপিক ইন্ডাস্ট্রিজ, মেঘনা ভেজিটেবল, ঈগল বক্স, রাবেয়া ফ্লাওয়ার, ই এল কেমিলিয়া।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদনের সময় সংশ্লিষ্ঠ কোম্পানির কাগজপত্র সঠিকভাবে যাছাই-বাছাই, সরেজমিনে কোম্পানির অস্তিত্ব সঠিকভাবে দেখা হচ্ছে না বলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জগুলো কোন কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার আগে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের টাকা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। আর এজন্য বিনিয়োগ সুরক্ষা তহবিল গঠন করা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তারা।
প্যারাগন লেদারের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন বিনিয়োগকারী আব্দুল হাই। তিনি বলেন, ‘কোম্পানিটিতে তৎকালীন সময়ে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। কোম্পানিটি ২০০৪ সালে বাজার থেকে তালিকাচ্যুত হয়। এরপর থেকে বহু ঘোরাফেরা করেও এ টাকা ওঠাতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘বাজার থেকে টাকা উত্তোলনের সময় কোম্পানিগুলোকে যত সহজে অনুমোদন দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। তালিকাচ্যুতির সময় এতো সহজে বিনিয়োগকারীরা অর্থ ফেরত পায় না।’ তাই কোনো কোম্পানি তালিকাচ্যুতির পূর্বে বিনিয়োগকারীরা যাতে বিনিয়োগকৃত অর্থ সহজে ফেরত পায় এবং বিনিয়োগ যাতে সুরক্ষিত থাকে তেমন নিয়ম নীতি ও আইন করার দাবি জানান তিনি।
এদিকে পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিভিন্ন সংস্কার অব্যাহত থাকলেও তালিকাচ্যুত কোম্পানিগুলো আটকে থাকা অর্থ বিনিয়োগকারীদের নিশ্চিত ফেরতের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকারসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নীতিমালা না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থ বছরের পর বছর পরে থাকলেও তা উদ্ধারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। এতে আইনি দুর্বলতায় একদিকে কোম্পানিগুলো পার পেয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘তালিকাচ্যুত কোম্পানির অর্থ ফেরত দেয়া নেয়া সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। আইন অনুয়ায়ি কোম্পানির দেনা পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট অর্থ শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে বন্টন করতে পারবে আদালত।’ এ ক্ষেত্রে বিএসইসির কোনো ক্ষমতা নেই বলে জানান তিনি।