শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > অর্থ-বাণিজ্য > ১০ হাজার টাকায় এক ইউনিট বিদ্যুৎ!

১০ হাজার টাকায় এক ইউনিট বিদ্যুৎ!

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চুক্তি অনুযায়ী ৭ টাকা ৭৮ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনার কথা সরকারের। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গড়ে বিদ্যুৎ কিনেছে ১৮ টাকা ২১ পয়সায়। আগের বছর এটি ছিল ১৮ টাকা ৯১ পয়সা। এর মধ্যে গত নভেম্বরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। পাওয়ারপ্যাকের ফার্নেস অয়েলচালিত ১০০ মেগাওয়াট কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় এ ঘটনা ঘটেছে।

গত দুই বছরে দুই দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে বলে মনে করছে পিডিবি। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ সময়ে জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। আর এ কুইক রেন্টাল কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গত বছর ১৩৪ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করেছে পিডিবি। আগের বছর কিনেছে ১৪৩ শতাংশ বেশি দামে।

গত ১ থেকে ২৯ নভেম্বর উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। ৩০ নভেম্বর ১১ হাজার ৮৮০ ইউনিট বিদ্যুৎ উত্পাদনে জ্বালানি ব্যয় হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যার বিপরীতে পিডিবি বিল পরিশোধ করে ১১ কোটি ৮৬ লাখ। ইউনিটপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা। এতে অজ্বালানি ব্যয় ১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বিতরণ কোম্পানির কাছে ৪ টাকা ৭০ পয়সা ইউনিট বিক্রি করায় নভেম্বরে পিডিবির লোকসান হয় ১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জরিমানা দিতে হয়। তবে পিডিবির আদেশে উৎপাদন বন্ধ রাখা হলে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বন্ধ রেখে ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে রেশনিং করে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ধ রাখার ব্যবস্থা থাকলেও ফার্নেস অয়েলচালিত এ কেন্দ্র বন্ধ রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) তমাল চক্রবর্তী বলেন, কাউকে সুবিধা দেয়ার কোনো বিষয় নেই। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। এেেত্র ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এক মাসের উৎপাদন না দেখে বছরের উৎপাদন হিসাব করে গড় করলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

পাওয়ারপ্যাকের েেত্র নিজস্ব বিনিয়োগ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক একটি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ইঞ্জিন বাবদ ব্যয় হয় মানভেদে ৪৫০-৬০০ কোটি টাকা। অথচ একই মতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পাওয়ারপ্যাক ব্যয় দেখিয়েছে ৮৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। যদিও ক্রেডিট রেটিংয়ের সময় ৪৯ শতাংশ ঋণ নেয়ার কথা বলেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বিদেশী কোম্পানির অংশীদারিত্বের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি। বরং দরপত্রে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান মুতিয়ারার নাম ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়ায় পাওয়ারপ্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড চরম অস্বচ্ছতার নজির সৃষ্টি করেছে। কোনো ধরনের নিজস্ব বিনিয়োগ ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে পাওয়ারপ্যাককে ৫৯৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি, মোট বিনিয়োগের যা ৭২ শতাংশ। বাকি ২৮ শতাংশ অর্থাৎ ২৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে পাওয়ারপ্যাক। তবে প্রকল্পটিতে মুতিয়ারার কোনো বিনিয়োগ নেই বলে নিশ্চিত করেছেন ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্যই মুতিয়ারার সঙ্গে কনসোর্টিয়াম করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

গত অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে ৩৩ কোটি ৫ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কিনেছে পিডিবি। এজন্য জ্বালানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৪৪৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। এতে করে ইউনিটপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ১৩ টাকা ৪৭ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি ইউনিটে সর্বোচ্চ ২ টাকা পরিচালন ব্যয় যোগ করা হলেও ব্যয় সাড়ে ১৫ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা। অথচ দুই বছর ধরে ইউনিটপ্রতি ১৮ টাকার বেশি ব্যয় করছে পিডিবি।

এ প্রসঙ্গে পাওয়ারপ্যাকের পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ তানভীরুল ইসলাম মোহন বলেন, ‘উৎপাদন বন্ধ রাখলে আমাদের বেশি তি হয়। আর বন্ধ রাখার বিষয়টি নির্ভর করে পুরোপুরি পিডিবির ওপর। তারা তাদের সুবিধা মতো রেশনিং করে থাকে। এছাড়া আমাদের কারণে বন্ধ থাকলে জরিমানা পরিশোধ করতে হয়।’

২০১০ সালের ৮ জুলাই ফার্নেস অয়েলচালিত ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য পিডিবির সঙ্গে চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসার কথা ছিল ২০১১ সালের ৩১ মার্চ। কিন্তু উৎপাদনে আসে গত বছরের ২৭ মার্চ। অর্থাৎ উৎপাদনে আসতে ৩৬২ দিন দেরি করে কেন্দ্রটি। এজন্য গত এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রটি থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২৩ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিস্তিতে আদায় করা হচ্ছে আরো ৭৬ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এদিকে জামালপুর ১০০ মেগাওয়াট ও ১০০ মেগাওয়াটের খুলনা পিকিং পাওয়ার প্লান্টের কাজ পেয়েছে কনসোর্টিয়াম অব মুতিয়ারা অ্যান্ড পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস লিমিটেড। এ দুটি প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট চুক্তি হলেও বাস্তবায়ন কাজে কোনো অগ্রগতি নেই। গত ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি উৎপাদনে আসার কথা ছিল। এ দুটি কেন্দ্র উৎপাদনে না আসায় প্রথম মাসেই জরিমানা হয় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এ টাকা পরিশোধ না করে উৎপাদনে আসার তারিখ পেছানোর চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।