শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > জাতীয় > হায় রে রোহিঙ্গা জীবন!

হায় রে রোহিঙ্গা জীবন!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
হায় রে রোহিঙ্গা জীবন! মুসলিম বলেই কি তোমাদের এই দূরবস্থা? বস্তি জীবন; সেটাও আবার বন্দিত্ব? জন্মভূমি মগদের দখলে যাওয়ায় দুঃখ আর কাঁদায় ভরা বীভৎস জীবন যাপন!! নবজাতক শিশু, অবুঝ শিশু কিশোর-কিশোরী, বৃদ্ধা সবার অবস্থা অভিন্ন। কান্নাই যেন একমাত্র সম্বল। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশ দখল করে ইহুদিদের রাষ্ট্র তৈরি করে দিয়েছে বিশ্ব মোড়লরা। মুসলমান হওয়াই কি আরাকানের রোহিঙ্গাদের অপরাধ?

কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড় ও সমতল এখন বস্তির নগরী। যেদিকে চোখ যায় শুধু বস্তি আর বস্তি। কোথাও বাঁশের খুঁটিতে পলিথিনের আচ্ছাদনে ঢাকা খুপড়ি। কোথাও তেরপালের খুপড়ি। সর্বত্রই খাদ্য ও পানির সংকট তীব্র। একটু বৃষ্টি হলেই কাদা পানিতে সয়লাব হয়ে যায় পুরো এলাকা। কোনো তাবুর ভিতর হাঁটু পানি; আবার কোনো তাঁবুর ভিতর কাঁদায় একাকার। এর মধ্যেই মানবেতর জীবনযাপন করছে রাখাইন থেকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষ। ক্যাম্পের বাইরে তাদের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ বের হলে তাদের ধরে আবার শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এ যেন জমির ধান খাওয়া গরু-ছাগলকে শাস্তি হিসেবে খোঁয়াড়ে রেখে শাস্তি দেয়ার নামান্তর। বীভৎস বিভীষিকাময় মানুষের জীবনের এ চিত্র টিভির পর্দায় দেখে হুহু করে কাঁন্না আসে। দেশ বিদেশের টিভিগুলোর সচিত্র খবরে এ দৃশ্য নিত্যদিন দেখানো হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে এ কেমন মানবিকতা!

বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পে তেরপাল দেয়া খুপড়ি ঘর। বৃষ্টি হওয়ার কাঁদায় একাকার। কাদার মধ্যেই পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছেন মোছা: ফাহমিদা। রাতে ৫ জনের শোয়ার যায়গা হলেও গৃহকর্তী ফাহমিদার ঘুমানো সুযোগ হয়নি। ঢুলু ঢুলু চোখে রাত পার করেছেন। মাঝরাতে একজনের ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি ঘুমানোর সুযোগ নেবেন। কিন্তু না। ঘুমানোর সুযোগ পাননি তিনি। পরের দিন যান বলুখালী ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। এক বছরের সন্তান ইয়াসির আরাফাতকে নিয়ে মো: ফাহমিদা বেগম ত্রাণের অপেক্ষায় আছেন। দুই বাচ্চাকে নিয়ে এক সপ্তাহ আগে মংডুর মুইনসং গ্রাম থেকে এসেছেন। সাংবাদিকদের জানান, আগের দিন ত্রাণের জন্য এসে শূন্য হাতে ফিরে গেছেন। ভাগ্য যাচাইয়ে আবার এসেছেন ত্রাণের আশায়। কিন্তু ত্রাণ দেবে দুপুর ১২টার পর।

দুঃখ করে বলেন, আমাকে শূন্য হাতে ক্ষুধার্ত পেটে অপেক্ষা করতে হবে। শিশুসহ কয়েকশ’ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কক্সবাজারের বলুখালীতে ট্রাক থেকে ছুঁড়ে মারা ত্রাণ সংগ্রহের জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে। বাচ্চা কাঁধে কয়েকজন মহিলা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় বাংলাদেশীদের বিতরণ করা খাদ্য, তেরপল কিংবা ও পোশাক পাওয়ার আশায়। চারিদিকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে বলুখালীতে যেখানে অধিকাংশ পালিয়ে আসা নির্যাতিত শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে যারা ঝড়-বৃষ্টিতে মাত্রা ছাড়া অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে আছে। এদের একজন ‘আরিফা’ দীর্ঘক্ষণ শ’খানেক রোহিঙ্গার সাথে কোলাহলের মধ্যে অপেক্ষা করছেন সাহায্যের আশায়। তাঁর দুই বছরের কন্যা মিনারাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে আছেন সাহায্যে প্রার্থনায়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর আরিফা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার এবং কন্যা দু’দিন থেকে কোন ধরনের খাবার খাইনি।

আমার কাছে কোন খাবার নেই, কোন আশ্রয় নেই এবং কোন কিছু রান্না করারও নেই। সবকিছু রেখেই পালিয়ে এসেছি। আরিফা যখন সাংবাদিকদের নিজের করুণ কাহিনী শোনান তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। আর ওই বৃষ্টির সাথে অঝোর ধারায় চোখের পানি নেমে আসছে আরিফার মুখ বেয়ে। বলেন, ‘যদি আমি কিছু সাহায্যে পাই তবে কন্যাসহ না খেয়েই থাকতে হবে।’ আরিফা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব জেলার লামবাগুনা গ্রাম থেকে এসেছেন। জানালেন, তার স্বামী নবী হুসাইনকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। শরণার্থী এক সঙ্গী তার নিজের তেরপল আরিফাকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন যতদিন না আরিফা নিজের তেরপল সংগ্রহ করতে না পারে।

রোহিঙ্গা এক কিশোরীর অপেক্ষা
১০ বছরের শিশু মোছাঃ নূরে কায়াস। কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের বিপরীত পাশের রাস্তায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। নতুন রোহিঙ্গাদের আসতে দেখলেই দৌঁড়ে যাচ্ছে যদি বাবা-মাকে পাওয়া যায়। শত শত মানুষের শ্রোতে ভেসে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পে এসে সে চাচার পরিবারকে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু বাবা-মা-ভাই-বোনদের খুঁজে পাচ্ছে না। বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা জানেন না সে। তারপরও রক্তের টান। মন মানে না। হৃদয়ে ক্ষীণ প্রত্যাশা যদি বাবা-মাকে পাওয়া যায়! ছল ছল চোখে নূরে কায়াস সাংবাদিকদের জানায়, তাদের গ্রামের নাম বালিপাড়া। সে খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। এরই মধ্যে গ্রামে শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ আর অগ্নিসংযোগ। বাড়ি ফেরার পথেই বুঝতে পারে বাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। সেও পথেই অন্যান্যদের সঙ্গে সীমান্তের পথে ছুটতে থাকে। কয়েকদিন পায়ে হাঁটার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে শরণার্থী শ্রোতের সঙ্গে। কুতুপালং ক্যাম্পে এসে চাচা-চাচির পরিবারের দেখা পেলেও বাবা-মাকে পায়নি। এখন রাস্তার দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীর গাড়ি বা পায়ে হেঁটে রোহিঙ্গা শ্রোতের পথ চলা দেখলেই ছুঁটে যান যদি মা-বাবা-বোনের দেখা পান। শুধু নূরে কায়াস নয়; এমন শত শত শিশু-কিশোর-কিশোরী শরণার্থীর শ্রোতে বাংলাদেশে পৌঁছে শিবিরে ঠাঁই পেলেও বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে পাচ্ছেন না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগরা তাদের হত্যা করেছে।

নবজাতকদের নিয়ে বিপদগ্রস্ত মা
বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ত্রিপল টনানো তাঁবুতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দুই নবজাতক। বয়স তাদের ১০ দিন। মাদুরে ঘুমনো নবজাতকদ্বয়ের ঘন ঘন শ্বাস উঠা-নামা করছে বুক। মুরগির খোপের মতো ত্রিপলের তাঁবুর ভেতরে শিশু দুটির পাশে বসে মা মোছাঃ ইসমত আরা জানান, বৃষ্টির কারণে তাঁবুর নীচে কাদা হয়েছে। তাই বাঁশ আর কাঠ দিয়ে থকথকে কাদার উপরে একটি মাদুর পাতা হয়েছে। জ্বর-কাশির কারণে শিশু দু’টি রাতে এক মিনিটও ঘুমায়নি। মা’কেও সারারাত জেগে জেগে নবজাতকদের পাহারা দিতে হয়েছে। এখন নবজাতকদ্বয় ঘুমালেও মা ঘুমাতে পারছেন না। অথচ ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে জীবন বাঁচিয়ে পালিয়ে আসা মোছাম্মত ইসমতের আরো দেড় বছরের মেয়ে রয়েছে। সন্তানদের কান্না আর ক্ষুধার জ্বালায় দিশেহারা স্বামীহারা এই রোহিঙ্গা নারী। ১১ সেপ্টেম্বর রাখাইনের মংডুর ফকিরাবাজার থেকে একসপ্তাহ পায়ে হেঁটে পালংখালি আঞ্জুপাড়া সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অতঃপর ফাড়িরবিল প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে খোলা আকাশের নীচে জন্ম দেন জোড়া সন্তান। খ্যাংইখালী রাস্তা ধরে সদ্যজাত দুই সন্তানকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে অভুক্ত ইসমত শরণার্থী শিবিরে উঠেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, স্বামী ও এক দেবরকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। ঘরবাড়ি পুরিয়ে দিয়েছে। বৃদ্ধ শ্বশুর ও আরেক দেবরের সঙ্গে তিনি শরণার্থী শ্রোতের ভেসে বাংলাদেশে আসেন।

বাতাসে পচা লাশের গন্ধ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামগুলোয় দেশটির সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং শত শত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার পর এখন সেখানে সুনসান নীরবতা। আর বাতাসে শুধুই মানুষের লাশ পচা গন্ধ। কোথাও কোথায় মানুষের গোশত পোড়া উৎকট গন্ধ। সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা নিজ নিজ গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্য, এখনও রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী ও মগরা পাহারা দিচ্ছে। গত বুধবার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

৪০ বছর বয়সী মো: নূর আলমের বাড়ি মংডুর পূর্ব পাশের গ্রাম খাইন্দা পাড়া। নূর আলমরা চার ভাই পরিবার নিয়ে বুধবার নাফ নদী পাড় হয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফে প্রবেশ করেন। নূর আলমের অন্য ভাইরা হলেন- মোঃ আবুল হাশেম, মোঃ নূর হাকিম ও মোঃ ইসমাইল। বড় তিন ভাই বিবাহিত। ছোট ভাই এখনও বিয়ে করেনি। কয়েক দিন পায়ে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে সীমান্ত পাড় হওয়া নূর আলম রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় লাশের গন্ধের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমাদের গ্রামের নাম খাইন্দাপাড়া। ৭ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে আগুন দেয়। তখন আমরা আমাদের পাশের গ্রাম মগ্নিপাড়ায় আশ্রয় নেই। এরপর তিনদিন আগে আমরা বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা হই। মগ্নিপাড়া থেকে নাফ নদীর পাড় দিয়ে আসতে দুইশ’ গ্রাম আমাদের সামনে পড়েছে। সব বাড়িঘর পুড়ে গেছে। আমরা যখন গ্রামের জঙ্গল দিয়ে হাঁটছিলাম তখন পচা ও পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। মানুষের লাশ, রক্ত, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী মরে পচে এমন গন্ধ ছড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও পোড়া মানুষের আধা পোড়া গোশত থোকা থোকা হয়ে পড়ে রয়েছে। পোড়া গোশতের ওপর মাছি ভন ভন করছে। কিছু লোকজন এখনও গ্রামে আছে। তবে সেনাবাহিনী এখন খালি গ্রাম পাহারা দিচ্ছে।

৫২ বছরের মো: আবু তালেবের বাড়ি রাখাইনের কাদির বিল এলাকায়। তার বাবার নাম মো: ইয়াকুব। তাকে হত্যা করেছে নাশাকা বাহিনী। এক ভাই ও চারবোনের সবাই বিবাহিত। তার স্ত্রীর নাম মোছাঃ হামিদা খাতুন। চার ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে তিনি বুধবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, কাদির বিল গ্রামের বাড়িঘরে ১৬ সেপ্টেম্বর আগুন দেওয়া হয়। এরপর রাতেই বাড়ি থেকে পালিয়ে তারা অন্য গ্রামে চলে যান। নলবুনিয়া নামক গ্রামে ৭/৮ দিন থাকার পর সেগ্রামেও আগুন দেয় নাশাকা বাহিনী। আর যুবকদের ধরে ধরে হত্যা করে। অতপর রাতের আঘারে গ্রাম ছেড়ে সীমান্তের পথে পা বাড়ান।

তিনি বলেন, যেসব গ্রামে আগুন দিয়েছে সেসব গ্রামে কোনও মানুষ নেই। ঘর বাড়ি কিছু নেই। সব মাটির সঙ্গে মিশে আছে। চাল, ডাল, পরে আছে। মরা গরু-ছাগল খালে ভাসছে, মানুষের লাশ পরে আছে যেখানে সেখানে। রাস্তায় রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্ত। সেগুলো এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। সারা গ্রামে বিকট গন্ধ। মানুষের লাশের বিদঘুটে গন্ধে বাতাসে টেকা দায়।

আহত রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৩শ ৬৪ জনকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে বাংলাদেশ। আহত এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগই বুলেট ও বেয়নেটের মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা সহায়তা দেয়া সংক্রান্ত বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন এসব তথ্য জানান। এনায়েত হোসেন বলেন, ৩ হাজার ৫শ’ ২০ জন শরণার্থী রোহিঙ্গাকে ডায়রিয়ার চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তারা পালিয়ে আসার সময় পথেঘাটে খালের পানি পান করায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৭ হাজার ৯শ’ ৬৯ জন রোহিঙ্গাকে শ্বাসনালীর সংক্রমণ এবং ২ হাজার ৩শ’ ৩৫ জনকে চর্ম রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

পরিবার-পরিকল্পনা অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয় বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সাধারণ ডেলিভারির মাধ্যমে বাংলাদেশে দুশ’র মতো রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ২৫ দিনে মিয়ানমার থেকে নতুন করে ৪ লাখ ২৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৫শ’ ৭৫ জন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হয়েছেন। এই নিবন্ধন কার্যক্রম পুরোটা শেষ করতে আরও দুই মাস লাগবে। এ ছাড়া এতদিন ১০টি পয়েন্টে নিবন্ধন কাজ চললেও বৃহস্পতিবার থেকে তা বাড়িয়ে ৩০টি করা হয়েছে।

এক লাখ শিশু স্কুলের বয়স
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে পারিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে প্রায় এক লাখ শিশু এখনই স্কুলে যাওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এবং ইন্টার সেক্টর কো-অরডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) নামের একটি এনজিও। তাদের তথ্য হলো এসব শিশুর বয়স ৪ বছর থেকে ১৪ বছরের মধ্যে এবং তাদের এখনই স্কুলে পাঠানো জরুরি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাজ করা ইউনিসেফের কমিউনিকেশন ম্যানেজার এএম শাকিল ফায়জুল্লাহ বলেন, এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ০ থেকে ১৮ বছরের রোহিঙ্গা শিশু আছে দুই লাখ ৪০ হাজার। যাদের মধ্যে লক্ষাধিক শিশু এখনই স্কুলে যাওয়ার যোগ্য। ইউনিসেফের দাবি গত বছর অক্টোবরে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। আর চলতি বছরের ২৪ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যাদের ৬০ শতাংশই শিশু এবং তারা কক্সবাজারের কুতুপালং, উখিয়া, বালুখালি, লেদা অঞ্চলের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও মানবিক বিকাশে কাজ করেছে ইউনিসেফ, আইএসসিজি, সেভ দ্য চিলড্রেন, ব্র্যাক, কোডেকসহ কয়েকটি সংস্থা ও এনজিও। এসব শিশুকে লেখাপড়া শেখাতে স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোয় লার্নিং সেন্টার, চাইল্ড কেয়ার ও প্রি-স্কুলিং সেবা চালু করেছে তারা। এছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করতে ছবি আঁকা, লুডু-ক্যারামসহ আরও কিছু খেলাধুলার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে।

আইএসসিজি’র তথ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাশিশুদের লেখাপড়া শেখাতে ও মানসিক বিকাশে কুতুপালং, উখিয়া, বালুখালি, লেদা অঞ্চলে ১৭৩টি লার্নিং সেন্টার খুলেছে তারা। এর মধ্যে চারটি সেন্টার অস্থায়ী এবং বাকিগুলো স্থায়ী। এছাড়া এক লাখ রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে ১২ হাজার ৯শ ৩৪ জনকে তারা প্রি-স্কুলিং সেবা দেবে। এছাড়া চারটি অস্থায়ী কেন্দ্রে ৪শ’ ১৩ জন শিশুকেও তারা সেবা দেবে।

ইউনিসেফের কমিউনিকেশন ম্যানেজার এএম শাকিল ফায়জুল্লাহ রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর বিষয়ে বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রোহিঙ্গা শিশুকে তাদের নিজস্ব ভাষায় (বার্মিজ) লেখাপড়া শেখানো শুরু করা হয়। কিন্তু তারা যেহেতু একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে; সেহেতু তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই লেখাপড়া শেখানো বাদ দিয়ে তাদের প্রথমে বিশেষজ্ঞ কাউন্সিলর দিয়ে কাউন্সিলিং করানো হয়। এরপর শিশুদের ছবি আঁকা শেখানো, খেলাধুলাসহ অন্যান্য অনেক ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইনকিলাব