স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংসদীয় গণতন্ত্রে সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জাতীয় সংসদকে বোঝানো হলেও কার্যত দেশে বিরাজমান সংকট সমাধানে কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার সদিচ্ছার অভাবে সমঝোতার সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে গেছে সংসদের। বিষয়টি নিয়ে সংসদ অধিবেশনে কয়েকদফা আলোচনার সুযোগ করে দিয়েও সমাধানের কোনো ইঙ্গিত না মেলায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ও বিরোধী দলের অনমনীয় বিপরীত অবস্থানের কারণে সংসদে সংকটের সমাধানসূত্র খুঁজে বের করা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা দুই দলের নেতাদের মুখে মুখে ফিরলেও জাতীয় সংসদ এখন ‘কাগুজে বাঘে’ পরিণত হয়েছে। দুই দলের অনীহার কারণে সংলাপ-সমঝোতার প্রশ্নে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে সংসদ। তাদের মতে, শপথ নেয়ার পর থেকেই বহুদিনের অমীমাংসিত এ বিষয়টি সমাধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন স্পিকার।
গত বাজেট অধিবেশন শুরুর আগে তিনি একাধিকবার দুই দলকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রয়োজনে সংসদের বাইরেও সংলাপ আয়োজনে উদ্যোগ নিতে তার সম্মতির কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে সংলাপ সংসদে হলে স্পিকার হিসেবে তার ভূমিকা রাখার সুযোগ বেশি থাকবে জানিয়ে সংসদের অধিবেশনে বহুবার ইস্যুটি নিয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেন তিনি। আলোচনার জন্য দুই দল একমত হলে অধিবেশনের মেয়াদ বাড়ানো হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি। এতসব উদ্যোগ নিয়ে সুফল না পাওয়ায় হতাশ স্পিকার এখন নতুন করে এ নিয়ে আর উদ্যোগী হতেও রাজি হচ্ছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোকেই এ বিষয়ে সমাধান খুঁজে নেয়ার কথা বলছেন। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।
নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে গত দুই বছর ধরেই বিপরীতমুখী অবস্থানে বিরাজ করছে দুই দল। বিরোধী দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন আর ক্ষমতাসীন দল বলছে সংবিধানের আলোকে আন্তর্র্বতী সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এ নিয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটে দেশজুড়ে। সৃষ্ট সংকট সমাধানে দেশের সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংলাপের দাবিতে সোচ্চার হয়। দুই পক্ষ সংলাপে বসতে রাজিও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আয়োজনের অভাবে ভেস্তে যায় সব। এরপর সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলের যোগদানকে কেন্দ্র করে আশাবাদী হয়ে ওঠেন দেশবাসী।
সংসদের নতুন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দেয়া হলেও অধিবেশন শুরুর প্রথম দিনেই এ ইস্যুতে দেয়া মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে সেই আশায় ছাই ফেলে বিরোধী দল। তবে ইস্যুটি নিয়ে পরস্পরের মধ্যে অনির্ধারিত বিতর্ক চলে প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশার মেরুকরণ না ঘটায় সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে সরকারি দলও তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার ঘোষণা দেয়। দেশে এবং দেশের বাইরে একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। জবাবে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার হুমকি দেন। সাম্প্রতিক সময়ে দুই নেত্রীর এমন বিপরীতমুখী দৃঢ় অবস্থান শঙ্কিত করে তোলে দেশবাসীকে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিষয়টি সমাধানে সমঝোতার আহ্বান জানানো হয়। তৎপর হয়ে ওঠেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা। তারা দুই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে নিজেদের উদ্যোগে সমঝোতার পথ তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। এতসব তৎপরতার পরও সমাধানের কোনো আভাস না মেলায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন দেশবাসী। তবে আগামী ১২ সেপ্টেম্বরের সংসদ অধিবেশনকে ঘিরে আবারো আশাবাদী হয়ে ওঠেন সবাই। নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিতব্য এই অধিবেশনেই সবকিছুর সুরাহা হবে বলেও ধারণা করেছিলেন তারা। কিন্তু অধিবেশনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইস্যুটি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলও নিজেদের বক্তব্যের স্বপক্ষে হার্ডলাইনে অবস্থান নিয়েছে।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ এ বিষয়ে বলেন, আলোচনার জন্য সংসদের চেয়ে আর কোনো ভালো স্থান নেই। আমরা অপেক্ষা করছি তারা আসুক। আসার পর প্রস্তাব দিয়ে সংসদে আলোচনা করুক। একটা সমাধান নিশ্চয়ই হবে।
তবে বিরোধী দল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সংসদে এ বিষয়ে তারা কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করবে না। এ বিষয়ে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, সংসদে আলোচনায় বসতে কোনো আপত্তি নেই। তবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনের চিন্তা মাথায় নিয়ে বসলেই আলোচনা অর্থবহ হবে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি সরকারকে মানতে হবে। আর এ প্রস্তাব তাদেরকেই দিতে হবে। তারা তত্ত্বাবধায়ক নাম না রাখতে চাইলে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারই করুক। কিন্তু সেখানে তাদের দলের প্রধানকে প্রধান করতে পারবেন না। আমরা দলীয় কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না, এটা নিশ্চিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের চরম দুর্দিনে জাতীয় সংসদকে ঘিরে রাজনীতিক, কূটনীতিক, সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষের ছিল অন্তহীন প্রত্যাশা। কিন্তু দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে আন্তরিক হওয়া সত্ত্বেও সংসদে জনগণের সেই প্রত্যাশার মেরুকরণ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না স্পিকারের পক্ষে। তবে এখনো সমঝোতার সময় ফুরিয়ে যায়নি বলেই মনে করেন তারা। দেশের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দল চাইলে সংসদ সমঝোতার উদ্যোগ নিতে পারে। তা না হলে দেশের সহিংস রূপ শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না আইন প্রণয়নকারী এই প্রতিষ্ঠানটির।
এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এখন রাজনৈতিক দলগুলোকেই উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের সংকটপূর্ণ অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকেই অনুধাবন করতে হবে। তারা না চাইলে সংসদের কিছু করার থাকে না। সংকট সমাধানে সংসদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে না। তবে রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে স্পিকার হিসেবে সংসদে এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেবেন বলে জানান তিনি।