শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > স্বাগত মমতা, চাই তিস্তার স্পষ্ট ঘোষণা

স্বাগত মমতা, চাই তিস্তার স্পষ্ট ঘোষণা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: ৪৮ ঘণ্টার সফরে আজ বাংলাদেশে আসছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর আমন্ত্রণে তিনি ঢাকা আসছেন। সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাতে মমতাকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও। ১৮ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল থাকছে তার সফর সঙ্গী হিসেবে। এর মধ্যে সেলিব্রেটিরাও থাকছেন। বাংলাদেশে এটি হবে মমতার প্রথম সফর।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে মমতার এই সফর ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে। তার এই সফরের সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ইস্যু জড়িয়ে রয়েছে। এর একটি হচ্ছে স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন, অপরটি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর।

ইস্যু দু’টির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কম বেশি জড়িত। কারণ, ইস্যু দু’টি শান্তিপূর্ণ মীমাংসা না হলে তাতে ঘি ঢালবে বিরোধীপক্ষ। তিস্তা চুক্তিটি ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বিবদমান এই দু’টি ইস্যুর একটা মীমাংসা চেয়ে আসছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও ইস্যূ দু’টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। তবে গোল বাঁধিয়েছেন দিদি নিজেই। তিনি যদি আন্তরিক থাকতেন তা হলে ইস্যু দু’টি আরো আগেই মীমাংসা হতো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত দেড় বছর ধরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে দেন-দরবার হচ্ছে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার তিস্তা ও স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে খুবই আন্তরিক ছিলেন। র্তমানে নরেন্দ্র মোদী সরকারও মনে হচ্ছে সে পথেই হাঁটছেন।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই সফরে মমতার আসার কথা ছিল। কিন্তু সফরের শেষ দিকে হঠাৎ করেই তিনি বেঁকে বসেন। প্রতিনিধি দল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।

তার এই ‘হঠাৎ বেঁকে বসায়’ পুরো সফরটাই মাটি হয়ে যায়। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সীমান্তে গুলি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা ও চুক্তি হলেও অমীমাসিত থেকে যায় স্থল সীমান্ত ও চিস্তা চুক্তি। কারণ, এক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদনে মমতার সম্মতির প্রয়োজন।

মমতা না আসায় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ওই সময় ঢাকার সম্পর্ক একেবারেই বিপরীত মেরুতে চলে যায়। মমতা সম্পর্কে ঢাকায় এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাবও তৈরি হয়। তার ইমেজও প্রশ্নের মুখোমুখী হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য সরাসরি মমতাকে দায়ী করেন। ২০১৪ সালের ১১ মে সচিবালয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি হয়নি।’

তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ওই সময় ইস্যুটি লুফে নেয় বিরোধী দল বিএনপি। তারা ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে।

ওই সময় নানা সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মমতা এক ধরনের অবস্থান নিয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতায় আনার পক্ষে তার তৃণমূলের কয়েকজন এমপিকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। সারদা কেলেঙ্কারিতে এসব তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। বলা হয়, ওই সময় বিরোধী দলের আন্দোলনে সারদা গ্রুপ অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। পরে অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কলকাতায় গিয়ে স্বীকার করেন, সারদা কেলেঙ্কারির অর্থ আদান-প্রদানের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো প্রমাণ পায়নি।

অভিযোগ রয়েছে, দিল্লিতে বসা তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সুসম্পর্ক থাকায় মমতাদি সেই সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখন এমনও খবর বেরোয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে হারাতে খালেদা জিয়ার অবস্থান মজবুত করতেই মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি নিয়ে নাটকীয়ভাবে বেঁকে বসেন মমতা।

২০১২ সালের ১৬ নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, তিস্তা এবং স্থল-সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায?নের প্রশ্নে দীর্ঘসূত্রিতা নিয?ে বছর দেড?েক ধরেই ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটা কূটনৈতিক শীতলতার বাতাবরণ তৈরি হয?েছে। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়ই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একেবারে শেষ পর্যায?ে মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে তা আটকে যায?। তবে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ছিটমহল বিনিময়ের পথ সুগম করতে দু’দেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তির আলোকে নতুন করে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।

কিন্তু স্থল সীমান্ত চুক্তি ও এর আওতায় স্বাক্ষরিত প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনের বিল রাজ্যসভায় উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস, আসাম গণপরিষদ (এজিপি) ও বিজেপির বিরোধিতায় তা আটকে যায়।

মমতার আপত্তিতে সীমান্ত চুক্তি আটকে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন ছিটমহলের বাসিন্দারা। তারা এ নিয়ে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন। অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। ধীরে ধীরে মমতার অবস্থান পাল্টাতে থাকে। তিনি ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপার নমনীয় হন। গত বছরের ৩০ নভেম্বর মমতা বলেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করার লক্ষ্যেই তিনি ঢাকার সঙ্গে সীমান্ত ভূমি বিনিময় চুক্তি কার্যকর করবেন। অবশ্য আরেক খবরে এমনও জানা যায়, সারদা কেলেঙ্কারিসহ নানা ঘাত প্রতিঘাতে তিনি বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাইছেন আগামীতে। যদিও এই মুহূর্তে মমতা সংসদের ভেতর-বাইরে বিজেপি সরকারের বিরোধিতায় লিপ্ত।

বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে ভারতের ১১১ টি ছিটমহল রয়েছে। ১৭ হাজার ১৫৮ একর জায়গা নিয়ে এসব ছিটমহলে বর্তমানে ৩৭ হাজার ৩৬৯ জনের বসবাস। অন্যদিকে, ভারতীয় ভূখণ্ডে বাংলাদেশি ছিটমহল রয়েছে ৫১ টি। সব কটিই পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। সাত হাজার ১১০ একর জায়গা জুড়ে ওই ছিটমহলগুলোতে ১৪ হাজার ২১৫ জন বাসিন্দা রয়েছেন। উভয় দেশের এই ১৬২ টি ছিটমহলের বাসিন্দারা দীর্ঘকাল ধরে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছেন।

তিস্তা নদীর পানি প্রধানত: সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবা এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে তিস্তা (ডালিয়া) ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই ব্যারেজ ও সেচ-খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় তিস্তা ব্যারেজ শুষ্ক মৌসুমে অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই পানি ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য-দশা ঘোচানোর একটি বড় শর্ত হচ্ছে তিস্তায় ন্যায্য পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।

তিস্তা নিয়ে স্বাধীনতার পর আলোচনা শুরু হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এবং এটি কীভাবে ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে পরে আরও আলোচনার কথা ছিল। এই আলোচনা কখনো হয়নি।

১৯৮৬ সালে যৌথ নদী কমিশনের বিশেষজ্ঞ সভায় অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা তুলে ধরে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদীর ৭৫ শতাংশ এবং তিস্তাসহ আটটি নদীর ৫০ শতাংশ পানি দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমানভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। ভারত মনে করে নাব্যতার জন্য ১০ শতাংশ পানি রেখে দেওয়াই যথেষ্ট।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী, তিস্তা নদীতে ঐতিহাসিকভাবে শুকনো মৌসুমে ১৪ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। এর ৫০ শতাংশ অর্থাৎ সাত হাজার কিউসেকের কম পানি পেলে তা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হবে।

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাদ জানান, ভারতের ব্যারেজের ডান তীরের চাহিদা হলো ১৬ হাজার কিউসেক পানি। বাম তীরের চাহিদা আনুমানিক ছয় হাজার কিউসেক। ভারতের একার চাহিদাই ২২ হাজার কিউসেক। আর বাংলাদেশের ডান তীরের চাহিদা আট হাজার কিউসেক। অর্থাৎ তিস্তা থেকে সর্বমোট ৩০ হাজার কিউসেক পানি দরকার। এই পরিমাণ পানি ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নদীতে থাকে না। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও ঘাটতি থাকে। অথচ বাংলাদেশের জন্য ডিসেম্বর- মে মাসে পানি পাওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। কারণ, তাতে করে তিস্তার প্রায় সাড়ে সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ দেয়া সম্ভব হবে।

মমতা বাংলাদেশে আসছেন- এই খবরে তিস্তা পাড়ের ধুধু বালুচরের লাখ লাখ মানুষ আশায় বুক বেঁধেছেন। তারা চাইছেন মমতাদি এবার তিস্তা চুক্তির সুস্পষ্ট ঘোষণা দেবেন এবং কার্যকর উদ্যোগ নেবেন। আবার বান ডাকবে তিস্তার বালু চরে।

একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই, কো-রাইপেরিয়ান স্টেট ( ভাটির দেশ) হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া ওই নদীর অবাহিকায় বাংলোদেশ অংশে বসবাস করা নাগরিকদের স্বীকৃত অধিকার। উজান দেশ হওয়ায় ভারত গায়ের জোরে সেই অধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করতে পারে না। চুক্তির পরেও গঙ্গার পানির ন্যায্য হিসা না পাওয়ায় রাজশাহী ও বরেন্দ্র এলাকার বিস্তীর্ণ ভূমি আজ মরুতে রূপান্তরের পথে।

মমতা ব্যানার্জিকে বাংলাদেশের মানুষ ‘দিদি’ বলেই ডাকে। তার সাদাসিদে আড়ম্বরহীন জীবন বাংলাদেশের বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। তার সফর নিয়ে সেই সব মানুষের মধ্যে বড় ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। দিদির ‘ইতিবাচক মনোভাবে’ সেই প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে। মমতা ব্যানার্জি সেই প্রত্যাশায় তোমাকে স্বাগতম। বাংলামেইল ২৪ ডটকম