নদীপথে আসছে গলদা রেণু ও নফলি; দেশে প্রতিবল ঢুকতে বখরা ২০০০টাকা; শতকোটি টাকা অবৈধ লেনদেন;
টাকা পাচার হয় হুন্ডিতে;
জহুরুল কবীর: পলিব্যাগের বল নদীতে ভাসিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে নিম্নমানের গলদা রেণু দেশে আনছে চোরাকারবারীরা। চোরাই পথে আনা এসব রেণু উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মার্চ মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাতক্ষীরার দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, কলারোয়া ও ভোমরা সীমান্ত দিয়ে মৌসুমে রেণু পোনা চোরাচালানিতে অন্তত অর্ধ শত কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রেণু পাচারের এ বিপুল এই অর্থ মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে ভারতে। এতে যেমন ব্যাহত হচ্ছে দেশীয় গলদার উৎপাদন তেমনি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সর্বশেষ ২০২১ সালে বিপুল পরিমাণে রেনু আটক হলেও এর পর থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো ভারতীয় রেণু আটকের ঘটনা ঘটেনি। তবে নেপথ্য কারণ হিসেবে জানা যায় বল প্রতি দুই হাজার টাকা বখরা দেওয়া হয়। তাই আটক হয়না। প্রতিটি বলে প্রায় ৪০ হাজার গলদার রেণূ থাকে।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তের লক্ষীদাঁড়ী ২ নাম্বার, শাঁখরা ও পদ্মশাঁখরা সহ দেবহাটার সীমান্তের বিভিন্ন চোরাপথে প্রতিরাতে কয়েক হাজার বল বাগাদা ও গলদা রেণু পোনা আসে। এসব রেণু পোনা সরাসরি চলে যায় দেবহাটা উপজেলার কুলিয়ার পোনা বাজারে। দেবহাটার কুলিয়া ব্রীজ এর নিচে গড়ে উঠেছে ভারতীয় গলদা ও বাগদা রেণু পোনার বাজার। সেখান থেকে যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার ও এম্বুলেন্স যোগে এসব পোনা চলে যায় খুলনার ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা, রামপালের ফয়লা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা।
বর্তমানে চোরাকারবারীরা কলারোয়া উপজেলার দেয়ারা, ভাদিয়ালি, কেড়াগাছী, তলুইগাছা সীমান্ত এবং দেবহাটা উপজেলার নাংলা, ভাতশালা, খানজিয়া, পারুলিয়ার খেজুরবেড়ী ও সদরের ভোমরা, গয়েশপুর, বৈকারী সীমান্ত দিয়ে রেণু পোনা, মাদকসহ অবৈধ ভারতীয় চোরাই পণ্য আমদানির রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। কালিগঞ্জ উপজেলার বসন্তপুর, হিঙলগঞ্জ এবং শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী, রমজাননগর, নুরনগর সীমান্ত দিয়ে রেণু পোনা ও মাদকসহ ভারতীয় অবৈধ মালামালের চোরাই রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারীরা।
সূত্র জানায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সদর ও দেবহাটার সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গলদা ও বাগদা রেণু পোনার ব্যবসা চলছিলো গোপনে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা পলিপ্রতি ২ হাজার টাকা করে আদায় করে অবাধে ভারতীয় রেণু বাংলাদেশে ঢোকাতে সাহায্য করে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন অবাধে দেশে ঢুকছে ভারতীয় রেণু। যার ফলে প্রকাশ্যেই রমরমা চলছে চোরা রেণুর ব্যবসা। ভারতীয় এসব রেণু পোনা সাতক্ষীরা জেলাসহ খুলনার ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা, রামপালের ফয়লা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরা মাছ চাষ সংক্রান্ত বিভিন্ন ফেসবুক পেজে ফলাও করে গ্যারান্টিসহ ভারতীয় রেণু বিক্রির জন্য প্রচার প্রচারণা করে যাচ্ছেন। দেশি হ্যাচারির পোনাও ভারতীয় এসব পোনার কাছে টিকতে পারছে না।
নির্ভর যোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দেবহাটা উপজেলার গলদা রেণু বা বল পাচারের মূল হোতা কথিত এক মেম্বার। সবকিছু ম্যানেজ করার দায়িত্ব তার কাঁধে। যেখানে যা ম্যানেজ করার প্রয়োজন সে তাই করে। দেবহাটার নফলির (বাগদার রেণু) একমাত্র চোরাকারবারী শফিকুল হাজী। তার আবার ভারতের চেন্নাইতে একটি রেণুর নার্সারি আছে। অন্যান্যের মধ্যে পারুলিয়া খেজুরবেড়ী এলাকার ছোট জাকির, পারুলিয়া এলাকার হুন্ডি খোকন, নাংলা নওয়াপাড়ার আজগর, নুরুজ্জামান, মালেক, দেবহাটার হুন্ডি আলাউদ্দিন, মামুন হোসেনসহ বেনামি অনেক চোরাচালানিরা। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে চোরাই পথে গলদা রেণু আমদানির বিভিন্ন রুটে পাসিং ম্যান (পাচারকারী) হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছেন ভোমরা গয়েশপুর এলাকার কবীর হোসেন, আনারুল ইসলাম, দেবহাটা নাংলা এলাকার মালেক, শাখরা কোমরপুর এলাকার একজন জনপ্রতিনিধিসহ আরো কয়েকজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে চোরাই পথে প্রতিরাতে সহ¯্রাধিক পলিব্যাগে করে রেণু পোনা নদী দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়। যার মূল্য কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকা। তবে রেণুর বলের সাথে মাদকও পাচার হয় সমান ভাবে।
শ্যামনগরে পশ্চিম কৈখালী গ্রামের মৃত তারিক বাইন এর পুত্র শফিকুল ইসলাম (জঙ্গল), শৈলখালী গ্রামের আরশাদ বর্কন্দাজ এর পুত্র মোনাজাত, পুর্ব কৈখালী শামছুর শেখ এর পুত্র আরজ খান, পুর্ব কৈখালী খোকন এর পুত্র রাজ বাদশা, কারিকার পাড়ার সাত্তার এর পুত্র আব্দুল্লাহ, পশ্চিম কৈখালী গ্রামের খলিল মুল্লিকের পুত্র হাবিবুব, নিদয় কৈখালী গ্রামের আঃ গফ্ফারের পুত্র সুবিদ, গাড়াখালী গ্রামের কাশেম এর পুত্র সাঈদ, আস্তাখালী গ্রামের জুব্বার শেখ এর পুত্র হামিদ, গোলাখালী গ্রামের মৃত সিয়াম উদ্দিন এর পুত্র জামির হোসেন জামু, শৈলখালী গ্রামের কাশেম, আজিজুল, দেলোয়ার, শৈলখালী গ্রামের জুব্বার, ধীরাজ, পশ্চিম কৈখালী গ্রামের গফ্ফার, শৈলখালী গ্রামের মোস্তফা, কৈখালী ক্যাম্পের পাশে দেলোয়ার, রফিক, মনির, ইসমাইল শ্যমনগরে রেণু পাচারের সাথে জড়িত।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম জানান, ভারত থেকে আসা গলদ ও বাগদার রেণু পোনা সম্পূর্ণ অবৈধ। বিগত আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে ভারতীয় রেণু আমদানি করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তাহলে সরকারও রাজস্ব আয় করতে পারবে চাষীরাও রোগমুক্ত চিংড়ির রেণু সংগ্রহ করতে পারতো।
তবে আমরা চোরাই রেণু পরীক্ষা করে দেখেছি। এগুলোর সাথে কোন ধরনের ভাইরাস বা অন্য কোন জৈব পদার্থের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।