শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রিতে ভাটা

সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রিতে ভাটা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেট বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। রমজান এলেই আর ফুটপাত ও ক্যাসেটের দোকানে শোনা যায় না নারীবিদ্বেষী এই বক্তার ওয়াজ মাহফিল।

গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন ক্যাসেটের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, শুধু রমজান নয়, এখন স্থায়ীভাবেই সাঈদী ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন বিক্রেতারা। দোকানিরা বলছেন, যুদ্ধপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এই ব্যক্তির ওয়াজের ক্যাসেট কিনতে এখন আর কউ আসেন না। তাই আমরাও তার ক্যাসেট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি।

রাজধানীর পল্টন মোড়ে সুরবাণী’র বিক্রেতা শরিফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গত দুই বছর আগেও সাঈদী ক্যাসেটের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ব্যবসায়িক স্বার্থে গোপনে তা বিক্রি করতাম।

তবে সাঈদী ভক্তরা তার ওয়াজের ক্যাসেট খুঁজতে আগের মতো এখন আসেন না জানিয়ে তিনি বলেন, গত এক বছরে সাঈদীর ওয়াজের কোনো ক্যাসেট আমি বিক্রি করেনি। অথচ তার গ্রেফতার হওয়ার আগেও আমি বছরে ৪-৫শ’ ক্যাসেট বিক্রি করতাম। তিনি যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাজা পাওয়ার পর থেকে তার ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি কমে গেছে। বাধ্য হয়ে তার ওয়াজের ক্যাসেট রাখা বন্ধ করে দিয়েছি।

গত ১১ বছর ধরে ভ্যানে ওয়াজ বাজিয়ে বিভিন্ন বক্তার ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি করছেন আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, সাঈদী গ্রেফতার হওয়ার পর তার ওয়াজের ক্যাসেট গোপনে বিক্রি করলেও এখন কেউ রাখেন না, প্রকাশ্যে বা গোপনেও কেউ ক্যাসেট কিনতে চান না।

তিনি বলেন, আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণিত হওয়ার পর মানুষ তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

পাশে দাঁড়িয়ে ওয়াজ শুনছিলেন মজলু। সাঈদীর ওয়াজ এখন শোনেন কি না জানতে চাইলে সোজা উত্তর তার- সাঈদীর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে আমিও একবার জামায়াতের মিছিলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছিলাম। এখন তার ওয়াজ শুনলে মনে হয়, তিনি একজন ধর্ম ব্যবসায়ী। আমাদের আবেগ-অনূভূতি নিয়ে তিনি ধর্ম ব্যবসা করছেন।

মজলু বলেন, তিনি যখন আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধী প্রমাণিত হলেন, তখন বোঝা গেল, একাত্তর সালের অপকর্ম ঢাকতে তিনি ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

যাত্রাবাড়ীর বায়তুশ শরফ মসজিদের মুয়াজ্জিন ওদুদ মিয়া বলেন, সাঈদীকে এক সময় দেশের অনেক মানুষ সম্মান করতেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধাপরাধী না হলে স্বাধীনতাবিরোধী দলে কেন যোগ দিলেন?- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট মার্কেটিং করতো স্পন্দন অডিও ভিজ্যুয়াল লিমেটেড নামে একটি জামায়াতি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর কাঁটাবন মসজিদের পাশে তাদের শো-রুমে গিয়ে সাঈদীর কোনো ওয়াজের ক্যাসেটের দেখা মিললো না। সেখানে জাকির নায়েকসহ জামায়াতবিরোধী অনেক মাওলানার ক্যাসেট বিক্রি করা হলেও সাঈদীর কোনো ক্যাসেট নেই।

সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি করেন না কেন জানতে চাইলে এ প্রতিষ্ঠানটি কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলেন, আমরা এখানে চাকরি করি। তাদের দাবি, কোম্পানি এখন যে যে ক্যাসেট পাঠায়, আমরা সেগুলোই বিক্রি করি।

প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত আড়াই বছরে সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রির হার কমেছে ৭৮ শতাংশ। ২০০৯-২০১০ সালে আমরাই সাঈদীর পৌনে দুই লাখ ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি করলেও ২০১০ সালে তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর তা কমতে কমতে এখন ২৫ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।

জামায়াত-শিবিরও বিমুখ
সাঈদীর ওয়াজ শোনা এক সময় নিজেদের আমলের একটি অংশ মনে করলেও এখন তাকে নিয়ে সেই আবেগ-অনুভূতি নেই জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মাঝে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এই নেতার ওয়াজ আগের মতো শুনতে চান না কর্মীরাও।

জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের অনেকে নিজামী, মুজাহিদকে ‘রাজাকার’ বলে গালি দিলেও সাঈদীর ওয়াজ শুনে কান্নাকাটি করতেন। তারাও আজ সাঈদীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সাঈদী যুদ্ধাপরাধী মানতে নারাজ হলেও এসব কর্মীরা তিনি যে মানবতাবিরোধী বড় ধর্ম ব্যবসায়ী- এ কথা অকপটে স্বীকার করলেন।

পল্টনে থানার শিবির কর্মী শাফায়েত উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, পরিবার, সংগঠন কিংবা বড় ভাইদের কাছে সাঈদীর ওয়াজের কথা শুনে তার দু’টি ওয়াজ শুনেছি। শোনার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি ইসলামের মূল বিষয়গুলো বাদ দিয়ে নারী, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, আর কিছু ব্যক্তিকে আক্রমণ করেই বেশি সময় পার করেছেন।

বর্তমান ইসলাম ও এর সমস্যা নিয়ে সাঈদীর ওয়াজে তেমন কোনো দিক-নির্দেশনা ছিল না বলেও মনে করেন শাফায়েত। তিনি স্বীকার করে বলেন, শুধু আবেগকে পুঁজি করে তার ওয়াজ শুনেছি। বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল ছিল না।

শিবিরের একাধিক শাখার কর্মীরা বলেন, সাঈদীর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে এক সময় আমরা মিছিলে যেতাম। এখন বুঝছি, তিনি তার ওয়াজে জাস্ট আমাদের অনুভূতিকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

তারা বলেন, সাঈদীর অন্য যেকোনো গুণ না থাকুক, এটা স্বীকার করি যে, তার বাচনভঙ্গি অসাধারণ। নিতান্ত অবিশ্বাসী মানুষও বোধহয় কান পেতে শুনবেন, লোকটা এতো সুন্দর করে কি কথা বলছেন। ছোটবেলার সেই আবেগটা নেই। তাই এখন তার ওয়াজ আর শুনি না।

শফিকুল ইসলাম নামে ঢাকা মহানগর পূর্বের একজন শিবির কর্মী বলেন, সাঈদীর ওয়াজে একটি বিষয় খেয়াল করলাম, নারী প্রসঙ্গ এলেই তিনি কোনো না কোনো ভাবে শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরীর দিকে নিয়ে যেতেন। তার ওয়াজে বেশিরভাগ সময় অন্য ধর্মকে হেয় করা একটি অপচেষ্টা থাকতো। বিষয়টি আমার কাছে পরিস্কার হওয়ার পর তার ওয়াজ শোনা বন্ধ করে দিয়েছি।

ইসলাম গ্রহণের নামে প্রতারণা
সাঈদীর ওয়াজের সময় দেখানো হতো, তার ওয়াজ শুনে ভিন্ন ধর্মালম্বীরা ওয়াজের মঞ্চেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। এটিকে পুঁজি করেই তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসলে কোনো ভিন্ন ধর্মালম্বী ওয়াজের মঞ্চেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন না। জামায়াত-শিবিরের একটি গ্রুপ বিভিন্ন এলাকার গরিব মুসলমানদেরকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে এ কাজ করাতো। তারাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সেজে মঞ্চে ইসলাম গ্রহণের নাটক করতেন।

ধর্মের নামে এতো বড় অনাচার মানুষ করতে পারে তাও কখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না- এমন মন্তব্য করে শিবির কর্মী ওয়াহাব বলেন, জামায়াত-শিবিরের গভীরে প্রবেশ করার পর জানতে পারলাম সাঈদীর হিন্দুকে মুসলামান বানানোর এ নাটকের কাহিনী।

তার মতে, ওয়াজ শুনে যে কয়জন হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তারা সবই ভুয়া। তারা সবাই আসলে অন্য এলাকা থেকে ধরে আনা গরিব মুসলমান। ধর্মের ভয়ে কিংবা টাকার লোভে তাদেরকে অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছে। এ ভয়াবহ সত্যটা বুঝতে আমার তিন বছর সময় লেগেছে।

নারী নিয়ে বেশি সময় ব্যয়
ওয়াজ মাহফিলে সাঈদী নামাজ, রোজা, যাকাত ও জিহাদের চেয়ে বেশি কথা বলেন নারীদের নিয়ে। এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাওলানা ওবায়দুল হক বাংলানিউজকে বলেন, নারীকে নিয়ে ওয়াজ করলে শ্রোতা ধরে রাখা যায়। এছাড়া তিনি যখন ওয়াজ করতেন তার বেশিরভাগ শ্রোতা ছিলেন তরুণ প্রজন্মের। নারীর শারীরিক নানা বিষয়, সেক্সের মতো বিষয়গুলো দিয়ে তিনি শ্রোতাদের ধরে রাখতেন।

তিনি বলেন, তার ওয়াজগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইসলামের মূল বিষয় থেকে সরে গিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ বেশি দেখেছেন তিনি। কি ওয়াজ করলে মানুষ ক্যাসেট বেশি কিনবেন সে দিকটি মাথায় রেখে টপিক নির্ধারণ করতেন সাঈদী। আর এটি করতে নারীকে বারবার বেছে নিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, যুব সমাজের পাশাপাশি তার মূল দর্শক পুরুষ হওয়ায় নারীকে বিনোদনের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতেন সাঈদী।

ওবায়দুল হক বলেন, তার ওয়াজে সাম্প্রদায়িক কথা বার্তা বেশি থাকতো। তার ওয়াজে সাম্প্রদায়িক কথার হার ছিল ৪৪ শতাংশ। এরপরই আছে নারীদের বিষয়ে। এ বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন ৪২ শতাংশ। নারীদের কথা বলার সময় তিনি সেক্স, নারী অধিকারের নামে নারীদের অপমান সম্বলিত কথা বার্তাই বেশি বলতেন।

এরপর তিনি রাজনীতি ও নানা মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলেছেন ৯ শতাংশ। বাকি সময় তিনি হামদ, নাত, কোরআনের বিভিন্ন আয়াত পড়তে ব্যয় করেছেন।

তিনি বলেন, গবেষণা করে আমি আরো দেখেছি, সাঈদীর ওয়াজের ৪৭ শতাংশ সময় তিনি নানা অসংলগ্ন কথা বার্তা বলে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। সবকিছুর উদ্দেশ্য একটিই- সহজে জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া।

ভারতবিরোধী কথা ছিল তার বেশি। আমি গবেষণায় এটাও পেয়েছি যে, তিনি যে কয়েকটি বিধর্মীদের দেশকে নিয়ে কথা বলেছেন, তার মধ্যে ভারতকে নিয়ে কথা বলেছেন সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ তার বহির্বিশ্বের কথার মধ্যে তিনি ৬৪ শতাংশ সময় ভারতবিরোধী কথা বলেছেন। এরপর ইসরাইল ১৯ শতাংশ এবং বাকি সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়ার মতো দেশের সমালোচনা করেছেন। তার সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও।

সাঈদীর ওয়াজ ইসলামের সঙ্গে এক ধরনের ভণ্ডামি ও প্রতারণা মন্তব্য করে মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তিনি আলেম সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে জঙ্গি দল জামায়াতের নেতা সেজেছেন। তার ওয়াজে তিনি সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা বাধানোর উদ্দেশ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দেওয়াসহ নানা কটূক্তি করেছেন।

সাঈদী ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি কমে যাওয়ার মূল কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ধর্মকে নিয়ে তিনি যে ব্যবসা করেছেন সেটা আবেগি মুসলমানরা বুঝে গেছেন। আগামীতে তার গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে বলেও মন্তব্য করেন মিছবাহুর রহমান চৌধুরী। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম