শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > সরকারি স্কুলে শিক্ষায় হযবরল অবস্থা

সরকারি স্কুলে শিক্ষায় হযবরল অবস্থা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ দেশের বিভিন্ন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কোচিংবাজ শিক্ষকদের বদলি করা হচ্ছে। যেসব শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে আছেন ও যারা কখনোই মাঠপর্যায়ে চাকরি করেননি, তাদেরও বদলি করা হবে। এর মধ্যে কোচিং ও নানা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ‘দাগি’ শিক্ষকদের তিন পার্বত্য জেলায় পাঠানো হবে। বাকিদের পাঠানো হবে দেশের প্রত্যন্ত উপজেলায়। রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মূলত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট নিরসনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে সরকার ৫টি কৌশল নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ‘দাগি’ শিক্ষকদের বদলি হবে শাস্তিমূলক। ‘ভালো’ কিছু শিক্ষককেও বদলি করা হবে, তবে তা শিক্ষার স্বার্থে।

ওই বৈঠকে যোগদানকারীদের একজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএস মাহমুদ। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রচুরসংখ্যক পদ শূন্য রয়েছে। নিয়োগের মাধ্যমে শূন্যপদ পূরণে যেহেতু বিলম্ব হতে পারে, তাই অর্ন্তর্বতীকালীন একটি পন্থা বের করতে রোববার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। তাতে ৫টি নীতির ভিত্তিতে বিদ্যমান শিক্ষকদের দিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরও জানান, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু-চারদিনের মধ্যেই বদলি কার্যক্রম শুরু হবে এবং শিক্ষক সংকটে ভোগা বিদ্যালয়গুলো নতুন শিক্ষক পাবে।

সূত্র জানায়, একদিকে শিক্ষক সংকট, আরেক দিকে শিক্ষকদের সুষম বণ্টন-সমন্বয়হীনতা- এ দু’কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে ‘হযবরল’ অবস্থা চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি তিন পার্বত্য জেলার স্কুলগুলোতে। ওই অঞ্চলের কোনো কোনো স্কুলে মাত্র ২ জন শিক্ষক নিয়েও চলছে। উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলোর দশাও করুণ। ওইসব স্কুলে শিক্ষক সংকট এমনই যে, তাতে লেখাপড়া এক প্রকার চলছেই না। অথচ এ অবস্থাতেই অনেক স্কুলে ডাবল শিফট পর্যন্ত চালু করা হয়। কিন্তু ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের স্কুলে বিপরীত চিত্র। ওইসব প্রতিষ্ঠানে প্রথমত শতভাগ শিক্ষক তো রয়েছেনই, কোনো কোনো স্কুলে সংযুক্তি নিয়ে প্রয়োজনের বেশি শিক্ষকও রয়েছেন। আবার অনেক স্কুলে বছরের পর বছর ধরে অবস্থান করছেন চিহ্নিত কিছু শিক্ষক, যারা সেখানে যেন ঘরবাড়ি খুলে বসেছেন। তারা সেখানে কায়েম করেছেন কোচিং বাণিজ্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পরিস্থিতি উত্তরণে অবশ্য সরকার মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ফলোদয় হয়েছে সামান্যই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি উত্তরণে বিদ্যমান শিক্ষকদের স্কুলের সংখ্যা বিবেচনায় সমহারে বণ্টন এক ধরনের সমাধান। এছাড়া শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ করে ও সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী নতুন পদ সৃষ্টি করে তাতে নিয়োগ দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব। এর মধ্যে যখনই কোনো শিক্ষককে এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়, তখনই প্রভাবশালীদের বিশেষ করে সরকারি দলের কোনো কোনো সংসদ সদস্য ও মন্ত্রির পক্ষ থেকে চাপ আসে। ফলে এই উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই ভেস্তে যায়। নতুন পদ সৃষ্টির একাধিক উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে শূন্যপদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু একটি নিয়োগ উদ্যোগ বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।

সারা দেশে বর্তমানে ৩১৯টি সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। জানা গেছে, এসব বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১ হাজার ৫৮০টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৩১৭টি পুরনো বিদ্যালয়ে বাংলায় ২৩০টি, ইংরেজিতে ২১০, গণিতে ১১৫, ভৌতবিজ্ঞানে ১৬৩, সামাজিক বিজ্ঞানে ৯৮, জীববিজ্ঞানে ১৫০, ব্যবসায় শিক্ষায় ১২০, ভূগোলে ৯৫, ইসলাম ধর্মে ১২০, কৃষিতে ৬১, শারীরিক শিক্ষায় ৮০, চারুকলায় ৯০ এবং ২টি নতুন বিদ্যালয়ে ৪৮টি পদ শূন্য রয়েছে।

মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন যুগান্তরকে জানান, শিক্ষক শূন্যতার বিষয়টি সামনে রেখে তা পূরণে তিনটি বিকল্প বিবেচনার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তাতে বিভিন্ন বিসিএসে উত্তীর্ণ অথচ ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হননি এমন প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশসহ অন্যান্য বিষয় রয়েছে। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী শূন্য পদ পূরণে অবশ্য বিলম্ব হতে পারে।

সাধারণত চাকরিজীবী এবং স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের সন্তানদের পড়ানোর জন্য পছন্দের শীর্ষে থাকে এসব বিদ্যালয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চাহিদা রীতিমতো শীর্ষে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- কম খরচ, উন্নত ভৌত অবকাঠামো ও ল্যাবরেটরি সুবিধা এবং দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের সুবিধাকে বিবেচনা। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার ব্যয়, গবেষণাগার সুবিধা এবং প্রাইভেট পড়ানোর প্রতি শিক্ষকদের অধিক ঝোঁক থাকায় অভিভাবকরা তা পরিহারের চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সরকারি স্কুলগুলোতেও সাম্প্রতিককালে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মতো চড়া হারে বিভিন্ন নামে-বেনামে ফি আদায় এবং শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটছে। অনেক স্কুলের শিক্ষার সার্বিক মানও নিুমুখী।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি স্কুলগুলোর মানের নিুমুখিতার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সুবিধাজনক অবস্থানের স্কুলগুলোতে বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের আত্মীয়স্বজনদের দায়িত্ব পালন ও নির্দিষ্ট কিছু স্কুলে অভিজ্ঞ-দক্ষ শিক্ষকদের ছড়াছড়ি। জানা গেছে, রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষকই পূববর্তী জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতা এবং সাবেক ও বর্তমান সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন। যে কারণে কয়েক মাস আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব প্রতিষ্ঠানে দশ বছরের অধিক সময় কর্মরতদের বদলি ও যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংখ্যা কম রয়েছে তাদের বদলি করে সমন্বয়ের আদেশ দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি।

রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এমনও বেশকিছু শিক্ষক রয়েছেন, যারা ১৫-১৮ বছর ধরে চাকরি করছেন। আবার কিছু শিক্ষককে বদলি করা হলেও তাদের রাজধানীর ভেতরেই এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে বদলি করা হয়েছে। ফলে স্কুলে কোচিং ও ভর্তি ব্যবসাসহ অন্যান্য বিষয়ে যে সিন্ডিকেট তারা গড়ে তুলেছেন তা বহাল তবিয়তেই রয়েছে। জানা গেছে, সরকার মাঝে-মধ্যে বদলির মাধ্যমে শিক্ষকদের সমন্বয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু অনেক সময়ে তা আদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আবার অনেক সময়ে কার্যকর হলেও তা নিরীহ শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য হয়।

নয়া ৫ নীতিতে এবারের বদলি : এ অবস্থার মধ্যে শিক্ষক বণ্টনে সমন্বয় আর সংকটাপন্ন স্কুলগুলোতে নতুন শিক্ষক দেয়ার জন্য যে ৫টি নীতি করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- একই প্রতিষ্ঠানে ১৫-২০ বছর ধরে কর্মরত শিক্ষকদের বদলি, শতভাগ শিক্ষক আছেন এমন প্রতিষ্ঠানে যারা কোচিং বাণিজ্যে জড়িত তাদের পার্বত্য অঞ্চলে ও উপজেলা পর্যায়ে বদলি, শিক্ষার্থী কম রয়েছে কিন্তু শতভাগ শিক্ষক আছেন এমন প্রতিষ্ঠানের ৫ ভাগ শিক্ষককে বদলি, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে নেই, এমন স্কুলে যারা সংযুক্ত আছেন তাদের শূন্যপদে অন্যত্র বদলি এবং যারা কখনও মাঠপর্যায়ে চাকরি করেননি, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ মেয়াদের শিক্ষকদের উপজেলা পর্যায়ে বদলি করা হবে। যুগান্তর।