শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > শীর্ষ খবর > সমঝোতা না হলেই আন্দোলন

সমঝোতা না হলেই আন্দোলন

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপ প্রত্যাখ্যান করলেও সমঝোতার পথ খোলা রেখে দাবি আদায়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলের চেয়ারপারসনের মুক্তিসহ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৈরি হচ্ছে কর্মপরিকল্পনা।

পাশাপাশি একতরফাভাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হলে বৃহত্তর ঐক্যের ব্যানারে সরকারবিরোধী দলগুলো নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়েও চলছে নানা তৎপরতা। এছাড়া পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, সংকট নিরসনে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত আলোচনার প্রস্তাব জানিয়ে যাবেন তারা। শেষ পর্যন্ত সরকার তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে রাজপথকেই বেছে নেবে দলটি। সরকারের দমননীতি মাথায় রেখেই আটঘাট বেঁধে অক্টোবরে আন্দোলনের শেষ আঘাত হানতে চায়। এর আগে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এড়িয়ে সতর্কভাবে চলার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য সোমবার বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অক্টোবর থেকে বৃহত্তর ঐক্যের ব্যানারে যুগপৎভাবে এ কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে একটি অভিন্ন রূপরেখাও প্রায় চূড়ান্তের পথে। এদিকে তফসিল ঘোষণার আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রায় গেলে তা আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা হবে। তবে এ ইস্যুতে সরকারের কোনো ফাঁদে পা দেবেন না তারা।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই বলছি খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।

তিনি বলেন, এজন্য আমরা বারবার সরকারকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছি। কিন্তু সর্বশেষ রোববারও প্রধানমন্ত্রী তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ক্ষমতার মোহে হয়তো তিনি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আশা করব তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। নির্বাচন সামনে রেখে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান দেশের স্বার্থে একান্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।

ফখরুল বলেন, সবার দাবি উপেক্ষা করে সরকার যদি একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে তবে তা জনগণই প্রতিহত করবে। তাদের ভোটাধিকারের জন্য তারা সবকিছুই করবে। আর জনগণের দাবি কখনও উপেক্ষিত হয়নি। এবারও হবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানোর বিষয়টি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দুরভিসন্ধিমূলক ছাড়া কিছু নয়। তাই সরকারের উচিত নতুন সংকট সৃষ্টির পরিবর্তে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়া।

রোববার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। এর আগের দিন শনিবার এক সমাবেশে খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকার গঠনসহ নির্বাচনে যেতে বেশ কিছু দফা তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা।

জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন- এ দুই ইস্যুতে আন্দোলনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করছে বিএনপি। তৃণমূল নেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই এ রোডম্যাপ চূড়ান্ত হচ্ছে।

এদিকে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক শোডাউন করা হয়। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে বিশাল সমাবেশ বিএনপির আÍবিশ্বাস অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। দলটির নেতারা মনে করেন, এ সমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ এবং যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত।

আন্দোলনের মাধ্যমেই চেয়ারপারসনকে মুক্ত ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় হবে। নির্বাচন নিয়ে সরকারের কঠোর অবস্থান প্রসঙ্গে বিএনপির করণীয় নিয়ে দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে একান্ত আলাপ হয়।

দলটির এক নীতিনির্ধারক বলেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সংকট নিরসনে নানাভাবে সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হবে। সরকার শেষ পর্যন্ত সংকটের সমাধান না করে একতরফাভাবে তফসিল ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে একযোগে মাঠে নামা হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে বৃহত্তর ঐক্য অনেকটা এগিয়ে গেছে। শিগগিরই তা চূড়ান্ত রূপ পাবে। তফসিলের আগে যার যার অবস্থান থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানানো হবে। এরপরও সরকার তফসিল ঘোষণা করলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহতের ঘোষণা আসবে।

২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে বিএনপির আরেক নীতিনির্ধারক জানান, ওই সময় তারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগ। বিএনপির বাইরে থাকা প্রায় সব দল নিয়ে তারা রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবীরাও ওই আন্দোলনে শরিক হন। একপর্যায়ে ওই সময় ঘোষিত নির্বাচন দিনক্ষণ বাতিল হয়ে যায়।

বিএনপির আন্দোলনও এবার অনেকটা ২০০৭ সালের মতো হতে পারে। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বৃহত্তর ঐক্যের ব্যানারে যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন হবে। পেশাজীবীরাও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাজপথে সক্রিয় হবেন। পেশাজীবীদের এবার মাঠে নামাতে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সেখানে শিক্ষক নেতাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গেও মতবিনিময় করা হবে।

বৃহত্তর ঐক্যের ব্যানারের পাশাপাশি চেয়ারপারসনের মুক্তি, তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারে দলীয়ভাবে কর্মসূচি পালন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এতে জোটের শরিকরাও থাকবে। তবে বৃহত্তর ঐক্যে জামায়াত নিয়ে আপত্তি থাকায় তাদের ঐক্য প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হতে পারে।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শুধু একটি দলের চেয়ারপারসন নন। তিনি গণতন্ত্রের প্রতীক। তার মুক্তি ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। দ্রুত মুক্তির জন্য তিনি কখনও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন না। সরকার গায়ের জোরে হয়তো আবারও একতরফা একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারবেন। কিন্তু এবার ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করা সহজ হবে না।

তিনি বলেন, সংকট নিরসনে সরকার শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় আসবে বলে বিশ্বাস করি। যদি তারা সেই পথে না হাঁটেন তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবার তার জবাব দেয়া হবে। আন্দোলনের জন্য দল প্রস্তুত আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে শাহজাহান বলেন, আওয়ামী লীগের আতঙ্কের নাম হল জিয়া পরিবার। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারা অন্তরীণ করে তারা ক্ষান্ত হননি। এবার তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ফরমায়েশি রায় দিয়ে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু এ দেশের মানুষের মনে জিয়ার পরিবার স্থান করে নিয়েছে। সরকার চাইলেও তা মুছে ফেলতে পারবে না। তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হলে নেতাকর্মীরা বসে থাকবে না। রাজনৈতিকভাবেই তা মোকাবেলা করা হবে।

বিএনপির নেতারা জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়ে সরকার বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতে পারে। সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এ ইস্যুকে সামনে আনা হতে পারে। তবে রায় বিপক্ষে গেলেও তা কৌশলে মোকাবেলা করবে দলটি। এ ইস্যুতে সরকারের ফাঁদে পা দেবে না তারা।

দলটির নেতারা মনে করেন, তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। তাই রায়ও হবে রাজনৈতিক। রাজনৈতিক মামলার রায় রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা হবে। দলটির একটি অংশ মনে করে, তারেক রহমান বর্তমানে দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক রায় হলে তা নেতাকর্মীদের আবেগকে আঘাত করতেই পারে। তবে সেই আবেগ যাতে সহিংসতায় রূপ না নেয় সে ব্যাপারে সতর্ক দলটির নীতিনির্ধারকরা। কারণ এ ইস্যুতে রাজপথে কঠোর আন্দোলন দিলে সরকার নতুন করে নেতাকর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেফতারের সুযোগ নিতে পারে।

নির্বাচনের আগে সক্রিয় নেতারা পুনরায় গ্রেফতার হলে তা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই এ ব্যাপারে তারা বেশ সতর্ক থাকবে। তবে রায় বিপক্ষে গেলে বিক্ষোভসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে দলটি। দলের কট্টরপন্থী একটি অংশ এ ইস্যুতে হরতাল দেয়ার পক্ষেও মত দিচ্ছেন। তবে সবকিছু নির্ভর করবে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের ওপর।

জানা গেছে, অক্টোবরে রাজপথে নামার অংশ হিসেবে সাংগঠনিকভাবে দলকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। যেসব জেলায় কমিটি নেই তা দ্রুত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুর মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। যেসব কমিটি আংশিক তা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে যেসব জেলা কমিটিতে বিরোধ রয়েছে তা এই মুহূর্তে পুনর্গঠন না করার চিন্তাভাবনা চলছে। বর্তমান কমিটিকেই সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে কঠোর আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দলের তৃণমূলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকেও সবাই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। তফসিল ঘোষণার আগেই তারা দাবি আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। সূত্র ; যুগান্তর