বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: কঠোর পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই চলমান সহিংসতা বন্ধ করতে চায় সরকার। এর জন্য সরকারের নেওয়া প্রশাসনিক ও আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এমন তথ্য।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা ও মন্ত্রী জানান, সহিংস পরিস্থিতি সামাল দিতে নমনীয়তা দেখানোর আর কোনো পথ সরকারের সামনে খোলা নেই। যেসব ধারাবাহিক ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি বর্তমান পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
বিএনপিকে বারবার আলোচনার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, চলমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগও সরকার দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে আন্দোলনের নামে সহিংতার পথ বেছে নিয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের ওইসব নেতা ও মন্ত্রী চলমান সংকটের আগের বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করেন। তারা জানান, ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিদের রাখার জন্য নাম চাওয়া হয়। বিএনপি তখন সংবিধান সংশোধন কমিটিতে যায়নি। এরপর এই কমিটি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তার চূড়ান্ত করার আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামত নেয়। ওই সময় বিএনপির সঙ্গেও আলোচনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তখনও বিএনপি সাড়া দেয়নি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর এই পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। পাশাপাশি লাগাতার সংসদ বর্জনও করে চলে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপিকে বারবার সংসদে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
বিশেষ করে ২০১৩ সালে ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী দশম জাতীয় সংসদে দেশের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সংসদ যাবার জন্য একাধিকবার আহ্বান জানান। তখন খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংসদে আসুন, সংসদে এসে কথা বলুন। সংসদ নেতা নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী, স্পিকার নারী। অন্তত আমরা তিন জন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলি;তাহলে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এভাবে আহ্বান জানানোর পরও বিএনপি তখন সংসদে যায়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা এ প্রসঙ্গে এভাবেই তাদের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরেন।
ওই বছর ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের আগে খালেদা জিয়া সরকার উৎখাতের আল্টিমেটাম দেন। তার সেই আল্টিমেটাম ব্যর্থ হয়। পরে ওই বছর ২৫ অক্টোবর থেকে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচনকালীন অন্তবর্তী সরকারে বিএনপিকে থাকার প্রস্তাব দেন। ওই নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু তাতেও বিএনপির সাড়া মেলেনি কোনো।
আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সর্বশেষ সংসদে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপে বসতে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ওই উদ্যোগেও রাজি হননি খালেদা জিয়া। এরপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন ঠেকাতে টানা অবরোধ হরতাল দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের কর্মসূচিতে যানবাহনে আগুন, বোমাবাজি, ভাঙচুরের ঘটনায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত ৫ শতাধিক স্কুল জ্বালিয়ে দেয়। তবে নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয় বিএনপি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, খালেদা জিয়াকে এভাবে বারবার আলোচনার আহ্বান জানানোর পরও তিনি সাড়া দেননি। অন্যদিকে তিনি সরাসরি সরকার উৎখাতের আল্টিমেটাম দিয়ে বসেন। কিন্তু তাতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সর্বশক্তি দিয়েও ঠেকাতে পারেননি খালেদা ও তার সমমনারা। আবারও ৬ জানুয়ারি থেকে টানা দুই মাসের বেশি সময় ধরে অবরোধ-হরতাল দিয়ে রেখেছেন যাতে সাধারণ মানুষের কোনো সাড়া নেই। এই কর্মসূচিও এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কর্মসূচির নামে চলছে সহিংসতা। আকস্মিকভাবে যানবাহনে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা, ভাঙচুর, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া, ককটেল সন্ত্রাস চলছেই। এই সহিংসতায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
এদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের চলমান অবরোধ-হরতালের সহিংসতার মধ্যোই খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর শোনার পর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানাতে তার কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি শেখ হাসিনা। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলোতে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। বিএনপির অবস্থান অপরিবর্তিত থাকায় শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে নেওয়া হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। চলমান এই সহিংসতার অবসানে দেশের ভেতর ও বাইরে বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের তাগিদ দেওয়া হয়। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে ‘আগে সহিংসতা বন্ধ করার’ আহ্বান জানানো হয়। সহিংসতা বাদ দিলেই কেবল সংলাপ হতে পারে বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে জানানো হয়। কূটনীতিকদের পক্ষ থেকেও সমঝোতার জন্য সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু টানা কর্মসূচির পাশাপাশি সহিংসতাও অব্যাহত রয়েছে।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে এই বিষয়গুলো উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তাদের সঙ্গে বারবার আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ফোন করেছেন। এসবই দেশের মানুষের জানা। এরপর আমাদের আর কি উদারতা দেখাতে হবে!
এদিকে আওয়ামী লীগের ওই নেতা-মন্ত্রীরা আরও জানান, বিএনপির টানা অবরোধ-হরতালে জনগণের সমর্থন নেই এটা তারা অনেক আগেই বুঝেছে। তাই তারা সহিংসতার ভয়ংকর পথটাই বেছে নিয়েছে। কিন্তু সহিংসতা চালিয়ে আর বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।
ওই নেতারা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে। সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বোমা ও বিস্ফোরক যাতে আসতে না পারে সেজন্য সন্দেহজনক এলাকাগুলোতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রয়েছে। দুনীতি মামলার পাশাপাশি সাম্প্রতিক ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ো হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিষয়ও আইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হবে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান।
চলমান পরিস্থিতির সমাধানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপি টানা দুই মাস ধরে অবরোধ-হরতাল করছে। এটা গিনেস বুকে রেকর্ড হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ আর এটা চায় না। এখন একটা সমাধানে আসতেই হবে। সমাধানের জন্য বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। বিদেশিদের ধরে লাভ হবে না। বিএনপিকে সরকারের কাছে আসতেই হবে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম