বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্ত্বর এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়ে ক্যাম্পাসে তাদের দাপট দেখিয়েছে সুর্যসেন হল ছাত্রলীগ কর্মীরা।
বিনা উস্কানিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৯ জন কর্মীকে কুপিয়ে জখম করেছে তারা।
কারা এই ছাত্রলীগ কর্মী? সকলেই জানে এরা সবাই স্থগিত কমিটির সভাপতি মোবারক হোসেন গ্রুপের।
রামদা, চাপাতি, রড, লোহার পাইপসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র এদের হাতে। আর তা দিয়েই সংবাদকর্মীদের কুপিয়ে, আঘাত করে জখম করেছে তারা।
এ ঘটনায় সুর্যসেন হল ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করে ১২ কর্মীকে প্রথমে ছাত্রলীগ থেকে এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়।
ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে শাহবাগ থানায়।
অভিযুক্তরা হলেন, শরিফুল ইসলাম ওরফে শরিফ (ইতিহাস, ৪র্থ বর্ষ), মিজানুর রহমান ওরফে মিজান( রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ২য় বর্ষ), বিদ্যুত (ম্যানেজমেন্ট, ২য় বর্ষ), মেহেদী (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ২য় বর্ষ), মোখলেছ (সমাজবিজ্ঞান, ২য় বর্ষ), হামিদ (দর্শন, মাস্টার্স), পারভেজ (সংস্কৃত), খোকন (সমাজবিজ্ঞান, ২য় বর্ষ), জাকির (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ২য় বর্ষ), সোহাগ, নোবেল এবং রাহাত।
সাংবাদিকদের অভিযোগ নাম না জানা আরও অনেকে এ হামলায় অংশ নেয়।
অভিযুক্তদের ওপর অনুসন্ধান করে দেখা যায় সাংবাদিক হামলার ব্যাপারটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বিভিন্ন হামলা সংঘর্ষ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ইভ টিজিংসহ সকল অপকর্মের সাথে জড়িত সুর্যসেন হল ছাত্রলীগের এসব কর্মী।
এদের নেতৃত্ব দেন তিন জন- শরিফ, শাহ আলম ও মিজান। আর এরা সবাই সুর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি মোবারক হোসেনের ঘনিষ্ট কর্মী।
মোবারকের ছত্রছায়াই তারা এসব অপকর্ম করে বেড়ায়, সে কথা ক্যাম্পাসে চাউর আছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী এসব কর্মী সম্পর্কে নানা তথ্য।
ছাত্রলীগ নামধারী এসব কর্মী ক্যাম্পাসে এহেন কোন অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড নেই যা করেনা।
তাদের অপকর্মের কয়েকটি খন্ডচিত্র বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
ভর্তিচ্ছুদের গাড়ী আটকে চাঁদাবাজি: গত বছরের পহেলা নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন সুর্যসেন হলের শরিফ, শাহ আলম ও তাকির নেতৃত্বে মুহসীন হল, জহুরুল হক হল ও এসএম হলের তাদের কয়েক সহযোগী।
রাজশাহী থেকে আগত ভর্তিচ্ছুদের বহন করা রাজকীয় পরিবহনের দুটি বাস ঢাবির মল চত্ত্বরে রাখা ছিল। বাসের ড্রাইভারকে জিম্মি করে এবং বাসের চাবি আটকে তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে এই মোবারক বাহিনী।
পরে অবশ্য ঘটনাটি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং তাকিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্রী উত্যক্ত:
গত ২৭ জুন মল চত্ত্বর এলাকায় অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করে শরিফের নেতৃত্বে মোবারক গ্রুপের কয়েক কর্মী।
ওই ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার ছোট বোন।
ছাত্রীটি নিজের এবং ভাইয়ের পরিচয় দিয়েও রেহাই পায়নি। ‘আমিতো আপনার বোনের মত। আমাদের ভাইও আপনাদের সাথে রাজনীতি করে। আমার সাথে আপনারা এমন করছেন কেন? মেয়েটির এমন আকুতির উত্তরে সেদিন শরিফ বলেছিলেন, ‘সবাই যদি বোন হয় তাহলে গার্লফ্রেন্ড হবে কে?
এরপর ছাত্রীটি তার ভাইকে জানালে বিষয়টি তিনি ঢাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফকে জানান। এরপর ওমর শরীফ সুর্যসেন হল শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডেকে সমাধান করেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক ব্যবসা:
একাধিক সুত্র জানায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন মাদক দ্রব্য বিক্রির সাথে জড়িত ছাত্রলীগের এসব কর্মী।
শরিফ, মিজান, শাহ আলম, মুক্তাদির, সোহাগ, বিদ্যুত নিয়মীত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা মাশোহারা নেয়। মাদকের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে গেলে তাদেরকে শায়েস্তা করে।
অভিযোগ আছে, মাদক ব্যবসায়ীদের সুর্যসেন হলে এনে আশ্রয়ও দেয় এসব কর্মী।
বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও ছিনতাই:
সুত্র জানায়, পকেটে টাকা না থাকলেই এসব কর্মী বেপরয়া হয়ে ওঠে। নিয়মিত ক্যাম্পাসে ভ্রাম্যমান দোকান ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দলবেধে চাঁদাবাজি করে।
এদের ছিনতাইয়ের কৌশলও অভিনব।
সুত্রমতে এরা দলবেঁধে সন্ধ্যার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে বেড়াতে আসা যুগলরাই এদের মূল টার্গেট।
নানা অজুহাতে এদের নাজেহাল করে ছিনিয়ে নেয় সাথে থাকা টাকা, দামী বস্তু ও মোবাইল ফোনসেট।
পরে এসব দামি মোবাইল ফোনসেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সন্ত্রাসীরা।
গত ১ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে একটি বাইক ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের অভিযোগে সুর্যসেন হলের ৩য় বর্ষের হাসান নামের এক ছাত্রকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ।
নম্বরপ্লেট বিহীন এক বাইক ব্যবহার করে সবাই:
সুর্যসেন হলের গেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রায়ই ইয়ামাহা ব্রান্ডের এফজেড সিরিজের নীল রঙের একটি বাইক চোখে পড়ে। বাইকটি নম্বরপ্লেট ছাড়া।
বাইকটি মোবারক ছাড়াও তার কর্মীরা নিয়মিত ব্যবহার করেন।
হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বাইকটি ছিনতাই করে আনা। তাই নম্বর প্লেট ব্যবহার করা হয়না। ছাত্রলীগ কর্মীরা চালায় বলে কেউ কোন প্রশ্নও করতে পারেনা।
হলের গেটে কর্মরত কর্মচারীদের কাছে বাইকটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘বাইকটি মোবারক ভাইয়ের। কিন্তু একেক সময় একেক জন চালায়।’
বাইকটির ব্যাপারে জানতে চাইলে মোবারক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাইকটি আমারই। গত এক বছর আগে কিনেছি।’
নম্বরপ্লেট না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমনিতেই ব্যবহার করিনা।’
তিনটি রুম সভাপতির দখলে:
হল সুত্রে জানা যায়, সুর্যসেন তিনটি রুম সভাপতি মোবারকের দখলে। রুম তিনটি হচ্ছে ৪২১, ৪২২ ও ৪২৩ যার চাবি তিনি নিজের কাছেই রাখেন।
তবে এ ব্যাপারে মোবারকের কাছে জানতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি ৪২১ নম্বর রুমে থাকি। বাকী দুই রুমে ছাত্রলীগের অন্য দুই নেতা থাকেন।
হলের দোকানে ফাও খাওয়ার মহোৎসব:
ছাত্রলীগ নামধারী এসব কর্মী সুর্যসেন হলের দোকান, ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকান থেকে দলবলসহ ফাও খায় বলে অভিযোগ করে ওই হলের একাধিক ছাত্র।
দোকানিরা ভয়ে তাদের কিছু বলার সাহস পায়না।
গেস্টরুমে সাধারণ ছাত্রদের অমানবিক নির্যাতন:
গেস্টরুমে প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ আছে শরিফ, শাহ আলম, মোখলেছ, জাকির, রাহাত, মুক্তাদির, সোহাগ এবং মেহেদীর বিরুদ্ধে।
এরা অকারনে জুনিয়রদের গায়ে নির্দ্বিধায় হাত তোলে। এছাড়া জুনিয়রদের পরষ্পরের গায়েও হাত তুলতে উৎসাহী করে। না তুললে ওইসব কর্মী নিজেরাই তাদের ওপর বেপরোয়া নির্যাতন চালায়।
অসহায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা এদের অত্যাচারে ঠিকমত ক্লাস- পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনা। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডেও এদেরকে জোর করে ব্যবহার করেন ছাত্রলীগের এসব কর্মী।
সাধারণ ছাত্রদের বিনা কারণে মারধর:
মিজানের নেতৃত্বে মোবারক গ্রুপের আরও কয়েকজন মিলে তারই বিভাগেরই এক বন্ধুর ওপর হামলা চালিয়ে আহত করে গত মে মাসে।
এছাড়া বিভিন্ন সময় হলের টিভি রুম, ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ ছাত্রদের মারধর করে এ গ্রুপটি। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম