বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা : ২০ দলীয় জোটের কোনো শরিক দল জোট ত্যাগ করলেও দলটির খণ্ডাংশ নিয়ে জোটের ঐক্য অটুট রাখছে প্রধান শরিক বিএনপি। যেকোনো মূল্যে জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে মরিয়া তারা। এজন্য কোনো শরিক দল জোট ছেড়ে গেলে তড়িঘড়ি করে দলটির অপরাংশকে জোটভুক্ত করা হচ্ছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ নেই এমন কাউকে খণ্ডাংশের চেয়ারম্যান করে জোটভুক্তির মাধ্যমে জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখা হয়েছে। এতে জোট শরিকেরা রীতিমতো বিব্রত। বিএনপি ও ২০ দল সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, বিএনপি ক্ষমতাসীনদেরকে ২০ দলীয় জোট নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি করার সুযোগ দিতে চায় না। সেজন্য জোটত্যাগকারী দলটির খণ্ডাংশ নিয়ে জোটের ঐক্য অটুট রাখছে তারা। এর মাধ্যমে তারা দেখাতে চায়, সরকার শত চেষ্টা করেও জোটকে ভাঙতে পারেনি।
তবে জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিএনপি। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘নিজেদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে জোটের শরিক অনেক দল ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিভক্তির পর নিজেদের স্বার্থেই তারা আবার জোটের অংশ হিসেবে থেকে যাচ্ছে। সুতরাং বিএনপি কোনো শরিক দলের খণ্ডিত অংশকে জোটভুক্ত করছে না।’
১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। পরবর্তীতে তা সম্প্রসারিত হয়ে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোট গঠিত হয়। জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। এরপর কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির একাংশ এবং সর্বশেষ সাম্যবাদী দলের একাংশ ১৮ দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে তা ২০ দলে পরিণত হয়।
জোট শরিকদের অবমূল্যায়ন ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ ও মতবিরোধের জের ধরে জোটে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানীর জোট ত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই সঙ্কট প্রকাশ্যে চলে আসে। বিএনপি তখন জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখার জন্য গাইবান্ধা জেলা কল্যাণ পার্টির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে রাতারাতি আরেকটি ন্যাপ ভাসানী সৃষ্টি করে। এই আজহারুল ইসলাম ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে হাতঘড়ি মার্কায় নির্বাচন করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জোট ত্যাগকারী ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক বাংলামেইলকে বলেন, ‘অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম কখনোই ন্যাপ ভাসানী করতেন না। এমনকি তিনি প্রাথমিক সদস্যপদসহ দলের কোনো পর্যায়ের নেতা ছিলেন না। রাতারাতি তাকে ন্যাপ ভাসানীর খণ্ডিতাংশের চেয়ারম্যান করে জোটভুক্তির মাধ্যমে বিএনপি নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ রেখেছে।’
এর কিছুদিন পর ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট একই অভিযোগে শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন এনপিপি বিএনপি জোট ত্যাগ করে। তখন অবিভক্ত এনপিপির মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে চেয়ারম্যান করে দলটির একাংশকে জোটে রেখে দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে শেখ শওকত হোসেন নিলু বাংলামেইলকে বলেন, ‘২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে আমি আমার মতামত তুলে ধরি। তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাকে ‘পাগল’ এবং জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাকে ‘গোপালী প্রেমিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরবর্তীতে উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচনে জোটের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমার বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘জোট ত্যাগকারী দলের খণ্ডিত অংশকে জোটে রেখে বিএনপি রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির প্রমাণ রাখছে, অদূর ভবিষ্যতে যার খেসারত বিএনপিকেই দিতে হবে।’
এরপর একই অভিযোগে আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বে এনডিপির একাংশ এবং এম এ রশিদ প্রধানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির একাংশ জোট ত্যাগ করে। তবে এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন দলটির মূল অংশ এবং অ্যাডভোকেট আব্দুল মোবিনের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক পার্টির মূল অংশ জোটে থেকে যায়।
২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে নতুন রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ন্যাপ ভাসানীর মূল অংশ, এনডিপি ও ইসলামিক পার্টির খণ্ডাংশ ওই জোটভুক্ত হয়। নিলু এনডিএফ’র চেয়ারম্যান এবং এনডিপির খণ্ডাংশের চেয়ারম্যান আলমগীর মজুমদার বর্তমানে ফ্রন্টের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি কাউন্সিলের মাধ্যমে ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোটের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মাওলানা আব্দুর রাকিব অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বে জন্ম নেয় নতুন ইসলামী ঐক্যজোট। জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের এই খণ্ডিত অংশকেই শরিক হিসেবে জোটভুক্ত করে বিএনপি।
তবে এ ঘটনায় জোটে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোটের শরিক দলের একজন চেয়ারম্যান বলেন, এ ধরনের ঘটনায় বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়কে ব্যবহার সম্পূর্ণ অনৈতিক। একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলের বিপরীতে হঠাৎ করে ঘরে বসে দল বানানো এবং সেই অংশকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করা কোনো সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়। জোট ত্যাগকারী দলের খণ্ডিত অংশকে জোটভুক্ত করার মাধ্যমে সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখার এই কৌশল জোটের জন্য মোটেই শুভ নয়।
জানতে চাইলে জোট ত্যাগকারী ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী বাংলামেইলকে বলেন, ‘দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম ৩১ সদস্যবিশিষ্ট মজলিসে সূরার ২৭ জন সদস্য ও কাউন্সিলদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছি। দলের ৩-৪ জন মিলে অন্য একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে কমিটি গঠনের কোনো বৈধতা নেই। ঘোষিত ওই কমিটি স্বঘোষিত ভোগাস কমিটি।’
তিনি দাবি করে বলেন, ‘সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে স্বঘোষিত ওই ভোগাস কমিটিকে জোটভুক্ত করার ঘটনা বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই না।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বাংলামেইলকে বলেন, ‘নিজেদের অনেক বড় মনে করে বিএনপি জোট থেকে বিভিন্ন সময় অনেকে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের আর অস্তিত্ব থাকেনি। যারা বেরিয়ে গেছেন তারা অতি ক্ষুদ্রাংশ। এতে জোটের কোনো ক্ষতি হবে না।’ বাংলামেইল২৪ডটকম