স্টাফ রিপোর্টার ॥ আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবনিজের ক্ষমতা খর্ব করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) আছে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে ইসি প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। এখন এই বিধান বাতিলের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।গতকাল রোববার ইসির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, ইসি মনে করছে, আরপিওর ৯১-ই ধারায় অস্পষ্টতা আছে, এটি প্রয়োগযোগ্য নয়। সে জন্য ধারাটি সম্পূর্ণ বিলোপের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।এর আগে গত বৃহস্পতিবার আরপিও সংশোধনের চূড়ান্ত প্রস্তাবের নথিটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সম্পূরক হিসেবে গতকালের প্রস্তাবটি দু-এক দিনের মধ্যেই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সব মিলিয়ে আরপিওর ৪১টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, বিদ্যমান আইন বৈষম্যমূলক। কারণ, যেখানে দুজন প্রার্থী আছেন, সেখানে নির্বাচনী অপরাধের কারণে একজনের প্রার্থিতা বাতিল হলে বৈধ প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল করতে হয় এবং সেখানে নতুন করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। এই বৈষম্য দূর করার জন্য কমিশন বৈধ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণার প্রস্তাব করেছে। কিন্তু তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কমিশন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। সে জন্য কমিশন পুরো বিধানটিই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলোপ এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করার পর নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রশ্নটি আলোচনায় আসে। সংসদে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হচ্ছে। অথচ নির্বাচন কমিশন নিজেই নিজের ক্ষমতা খর্ব করার সিদ্ধান্ত নিল।এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রশ্ন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা নিয়ে, দুর্বল করা নয়। ৯১-ই বাতিল করা হলে নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবে। এখন পর্যন্ত এই আইনটির প্রয়োগ না থাকলেও এর কারণে প্রার্থীদের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা কম ঘটে। কিন্তু ধারাটি সম্পূর্ণ বাতিল হলে প্রার্থীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবেন। তাতে কমিশনের করণীয় কিছু থাকবে না। নির্বাচনে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
আরপিওর ৯১-ই ধারায় বলা আছে, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা থাকার অযোগ্য হতে পারেন। তবে তার আগে কমিশন অভিযুক্ত প্রার্থীকে শুনানির যুক্তিসংগত কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেবে। তদন্তে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে কমিশন সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অন্য প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পর যদি একজন প্রার্থী অবশিষ্ট থাকেন, তবে সেই আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পুনরায় তফসিল ঘোষণা করা হবে।
কমিশন আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করে গত এপ্রিলে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তাতে ৯১-ই সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পর যদি বৈধ প্রার্থী হিসেবে একজন বাকি থাকেন, তবে সেই প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
এরপর জুনে কিছু পর্যবেক্ষণসহ আইন মন্ত্রণালয় নথিটি কমিশনে ফেরত পাঠায়। তাতে ৯১-ই এর বিদ্যমান ধারা বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কমিশন এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাব বহাল রেখে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব পুনরায় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কমিশনের এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপত্তি জানিয়ে বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, এই প্রস্তাব কমিশনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কারণ, কমিশন বিশেষ কোনো দলের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য অন্য দলের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে দিতে পারে।
বর্তমান কমিশনের আগে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। তাতে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনের সময়ে কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধান রাখা হয়। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতে বলেছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সব মন্ত্রণালয়ের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত শামসুল হুদা কমিশনের প্রস্তাবটি রাখা হয়নি। সব শেষে তাঁরা কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাটিও বাদ দেওয়ার সুপারিশ করতে যাচ্ছে।
কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, ৯১-ই ধারাটি বাতিল হলে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর কোনো প্রার্থী গুরুতর অপরাধ করলেও তাঁর প্রার্থিতা বাতিলের সুযোগ থাকবে না। তবে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় যৌক্তিক কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন।
এর আগে ২০০১ সালের ৮ আগস্ট তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে কমিশনকে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা দিয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দলের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত বিধানটি বাতিল করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কমিশনকে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তখন এ বিষয়ে আপত্তি করে বিএনপি। শেষ পর্যন্ত তদন্ত ও প্রার্থীকে যথাযথ শুনানির সুযোগ দেওয়ার বিধান রেখে ৯১-ই ধারা আরপিওতে যোগ করা হয়।
প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ ছাড়াও আরপিওতে উল্লেখযোগ্য আরও কিছু সংশোধনের সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিশন। বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজা পাওয়া ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হবেন। নির্বাচনে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে কার্যকর করতে নির্বাচনী অপরাধের সাজা কমানোর সুপারিশ প্রস্তাবে রাখা হয়েছে।