শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > শীর্ষ খবর > রোহিঙ্গারা কি তাহলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ?

রোহিঙ্গারা কি তাহলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ?

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
তীব্র শীতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা এক কথায় অবর্ণনীয়। ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে একের পর এক রোহিঙ্গা শিশু। এইডসের বিস্তারও ঘটছে। ইতিহাস বলে এই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সৃষ্টি ও স্বাধীনতার পিছনে পুরোধা হয়ে কাজ করেছে। মগরা ছিল বহিরাগত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস জাতি ও রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়ার পর এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একপ্রকার উপেক্ষা করে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব।

এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার নাম পরিচয় দেশটির সরকারের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে যখন বাংলাদেশ, তখন বার্মিজ সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে হামলা চালিয়েছে আরাকান স্যালভ্যাশন আর্মি বা ‘আরসা’ নামের একটি সংগঠন। কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা বসবাস করছেন তারা এমনিতেই মনে করেন এখন নিজদেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। তার ওপর আরসার এ ধরণের হামলা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে মনে মনে করেন রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, যেকোনো সন্ত্রাস কাজকে আমরা ভালোবাসিনা, এগুলো শুনতে আমাদের ভালোলাগেনা। আরসা কিসের লড়াই করবে?ওদের কিসের শক্তি আছে? আমরাতো বুঝতে পারছিনা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরসা’র নেতা আতা উল্লাহ লড়াইয়ের কথা বলেছেন। এ লড়াইয়ের পেছনে যে রাজনৈতিক ভিত্তি বা আর্থসামাজিক সাংগঠনিক প্রচেষ্টা থাকে তা রোহিঙ্গাদের মধ্যে পুরোপুরি অনুপস্থিত। তাহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো পরাশক্তি কি এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নষ্ট করে নিজেদের প্রভাব বলয় তৈরির ফন্দি আঁটছে? এধরনের তৎপরতা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সহ আশেপাশের সব দেশগুলোর জন্যে আখেরে কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। তাহলে রোহিঙ্গারা যাবে কোথায়? সাগরে ভাসতে ভাসতে যারা ডুবেছে তারা মর্মান্তিক পরিণতি লাভ করেছে। আর যারা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, পাকিস্তান অর্থাৎ যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় লাভ করেছে। বরণ করে নিয়েছে শরণার্থীর জীবন। কিন্তু এধরনের প্রচেষ্টা এখন প্রায় সম্ভব নয় বললেই চলে। ভারত বা বাংলাদেশে শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের অন্যত্র স্থানান্তরে কঠোর নজরদারিতেই আছে। মুসলিম দেশগুলো এ জনগোষ্ঠীকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার কোনো আশা সৃষ্টি করতে পারছে না। বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় নিজের ঘনবসতি উপেক্ষা করেও, পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের জীবন জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিয়েছে। সাহায্য সংস্থাগুলো এগিয়ে এসেছে। কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গারদের ফিরিয়ে নিয়ে মানবিক মনের পরিচয় দেবে তার কোনো ইঙ্গিত এখনো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।

এরই মধ্যে এক রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করার দায়ে বাংলাদেশি এক যুবকের দায়ের করা রিট খারিজ করে তাকে এক লাখ টাকা জরিমানার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চতর আদালত। পাচারকারী ও নারীদের নিয়ে যারা দেহ ব্যবসা পরিচালনা করেন তাদের খপ্পরে রোহিঙ্গা নারীরা পড়তে শুরু করেছে এমন সব খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফুটেজ সহ প্রকাশ হচ্ছে এবং এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে।

বাবুল হোসেন যার ২৬ বছরের ছেলেটি রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করেছে তিনি এএফপির কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, যদি বাংলাদেশি কেউ খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের মানুষকে বিয়ে করতে পারে তাহলে আমার ছেলে রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করে অন্যায় কি করেছে? সে একটি মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছে যে কি না বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তার ছেলেকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৪ সালে রোহিঙ্গাদের বিয়ে বাতিল করা হয়। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু জানিয়েছেন বাবুল হোসেনের ছেলেকে গ্রেফতার না করার জন্যে যে আবেদন করেছেন তাও আদালত খারিজ করে দিয়েছে।

এদিকে মিয়ানমার সরকার মনে করে, আরসার এই হামলা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই করা হয়েছে। বিবিসি বার্মিজ ভাষা বিভাগের মিন্ট সোয়ে বার্মিজ সরকারের মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ভীতি ছড়ানোর জন্যই এই ধরনের হামলা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার আরসাকে অভিযুক্ত করে বলছে, তারা দেখাতে চায় যে দেশের ভেতরে ফিরে আসাটা নিরাপদ নয়।

আরসার উদ্দেশ্য কী? এবং কেন তারা এধরণের তৎপরতায় লিপ্ত, সেটি অনেক রোহিঙ্গার কাছেই পরিষ্কার নয়। রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ বলেন, আরসা সংগঠন হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বশীল কিনা সেটি নিয়েও তার প্রশ্ন আছে। দিল মোহাম্মদর কথা হচ্ছে ‘আমরা ওদের দেখিও নাই, শুনেছি মাত্র। এরা কারা এটাও আমরা জানিনা।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মনিরুজ্জামান মনে করেন, আরসার এধরণের তৎপরতা রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, এধরণের তৎপরতা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিবিসি বাংলার খবরে আরো বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বিষয়টিতে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহী নয়। তবে আরসার নতুন হামলা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেই তাদের ধারণা। একই সাথে পরিস্থিতির ওপর বাংলাদেশ দৃষ্টি রাখছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

আরসার নেতা একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত রোহিঙ্গা। তিনি নিজেকে আতা উল্লাহ বলে পরিচয় দিচ্ছেন এবং গত অগাস্ট মাসে তিনি কিছু ভিডিও পোস্ট করে দাবি করেছেন যে রোহিঙ্গাদের আত্মরক্ষার জন্যই এসব হামলা চালানো হয়েছে। সর্বশেষ ভিডিওতে তিনি তার অবস্থান কোথায় তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। রোহিঙ্গা নিয়ে অন্যকোনো দেশ এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে তৎপর হয়ে উঠতে পারে এ আশঙ্কাও রয়েছে এবং বাংলাদেশকে এ ব্যাপারেও নজরদারী রাখতে হচ্ছে।

নিজদেশ থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্পে। এধরনের নানা বিপর্যয়ের কবলে পড়ে ক্রমশ: রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংকুচিত হতে থাকবে।

আমাদের সময়.কম