শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > রোহিঙ্গাদের দলে ভিড়িয়ে সংগঠিত হচ্ছে জেএমবি

রোহিঙ্গাদের দলে ভিড়িয়ে সংগঠিত হচ্ছে জেএমবি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশকে (জেএমবি) গুড়িয়ে দেওয়ার দাবি করলেও মাঠে এখনও সক্রিয় চরমপন্থী সংগঠনটি। প্রকাশ্য কার্যক্রম সেভাবে দেখা না গেলেও এখন রোহিঙ্গাদের দলে ভিড়িয়ে পুনর্গঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা। সে অনুযায়ী গোপনে চলছে সংগঠনটির তৎপরতা। বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। জেএমবি’র আস্তানা উচ্ছেদে কঠোর নজরদারিতে নেমেছে তারা।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একসঙ্গে দেশের ৬৩টি জেলায় ৪৫৯টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলোচনায় এসেছিল ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। সংগঠনটির নজিরবিহীন এ সন্ত্রাসী হামলায় আঁতকে উঠেছিল সারাদেশ। এরপর শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর শায়েস্তা কার্যক্রম। দলটির শীর্ষনেতারা ধরা পড়ার পর চরম শাস্তির মুখোমুখি হওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের তৎপরতা সেভাবে আর চোখে পড়েনি। ফলে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী দাবি করেছিল তারা সংগঠনটিকে গুড়িয়ে দিয়েছে। তবে সংগঠনটির বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নেতারা ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে দলটিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এদের সবচেয়ে বড় তৎপরতা দেখা যায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ হেফাজত থেকে তিন সাজাপ্রাপ্ত নেতাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা। আর তখন থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জেএমবি।
চলতি বছরে তাদের আরোও কিছু তৎপরতা চোখে পড়ে। এর মধ্যে রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে ৩০ জুলাই ব্যাপক পরিমাণ বিস্ফোরকসহ তিন জেএমবি নেতা গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন নিষিদ্ধ সংগঠনটি পুনর্সংগঠিত করতে অন্তত চারজন ব্যবসায়ী আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।
এ টাকা দিয়ে জেএমবি বান্দরবান এবং কক্সবাজার এলাকায় জমি কিনেছে এবং নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেছে।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে নিষিদ্ধ সংগঠনটি এখনও সক্রিয় এবং তাদের বিধ্বংসী আক্রমনের সামর্থ্য রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, জেএমবির নেতারা পুনর্সংগঠিত হতে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো বেছে নিয়েছে। যদিও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংগঠনটি পাহাড়ি এলাকা এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্য থেকে সদস্য সংগ্রহ করে নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি করছে।
ত্রিশালের ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর জন্য সতর্ক সংকেত ছিল। বর্তমানে তারা স্বীকার করেন যে সংগঠনটি নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। তারা দাবি করেন ত্রিশালে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নেয়া তিন জেএমবি নেতার মধ্যে দুইজন গোপন আস্তানা থেকে পুনর্সংগঠিত করার কাজ করছে। ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পরপরই অপরজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।
নতুন ধরনের পরিকল্পনায় জেএমবি নতুন সংগৃহীত সদস্যদের বোমার পরিবর্তে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
২০০৯ সালে গোয়েন্দারা বলেছিলেন, জেএমবি’র সঙ্গে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের বিদ্রোহী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। জেএমবির শীর্ষ নেতারা মিয়ানমার সীমান্তে ২০০২ সালে আরএসও’র অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
ফাঁসি হওয়া জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমান প্রশিক্ষণের জন্য তার লোকদের পাঠাতেন। রোহিঙ্গাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিনিময়ে জেএমবি বোমা তৈরি শিখত। বাংলাদেশের অপর আরেকটি নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ-আল ইসলামিরও (হুজি) শক্তিশালী যোগাযোগ রয়েছে আরএসও’র সঙ্গে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জেএমবির পুনর্সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। তিনি স্বীকার করেন, ত্রিশালের ঘটনাটির তথ্য আগেভাগে জানতে না পারা এলিট বাহিনী র্যাবসহ গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর জন্য একটা বড় ব্যর্থতা।
‘এখন আমরা জানতে পেরেছি জেএমবি রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নীলফামারীতে তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। এ এলাকাগুলোতে সাদা পোশাকের সদস্য এবং ইনফর্মার আরও বেশি করে মোতায়েন করা হয়েছে; জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে লোকবল স্বল্পতায় বাহিনীটি আর আগের মত ক্ষিপ্র নয়।’
পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সালাউদ্দিন আহমেদ ওরফে সালেহিন এবং জাহিদুল ইসলাম ওরফে ‘বোমা মিজান’-এর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,’ তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা কোথায় আছে তা এখনও জানতে পারি নি আমরা।’
এদিকে, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয় পর্যালোচনাকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুর রব খান জানান, জেএমবি সদস্যরা তাদের কার্যক্রম গতিশীল করেছে বিশেষ করে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা এবং কক্সবাজার এলাকায় সদস্য সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণে।
তিনি বলেন, ‘তারা এখন রোহিঙ্গা লোকজনকে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি জেএমবি সদস্যারা নিজেদের ছোটছোট গ্রুপে ভাগ করে এবং বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্বিধায় ফেলছে।’
তিনি আরও জানান, জেএমবি সদস্যরা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে যেসব দেশ রাজনৈতিক এবং সামরিক সঙ্কটে আছে।
তিনি বলেন, ‘সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং ইরাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের দেশ থেকে অনেক জঙ্গি গেছে। অন্যদিকে, জঙ্গিরা তাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। এটা বিপদজনক।’
অধ্যাপক আব্দুর রব তার পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরে বলেন,’কিছু ইসলামিক এনজিও গোয়েন্দা নজরদারিতে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে, জঙ্গিরা বিদেশ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেশে আনার জন্য এখন সোনা চোরাচালানের আশ্রয় নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি জঙ্গি দমনে র্যাবের প্রচলিত পদ্ধতি এখন কাজে আসবে না। তাদের উচিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, জেএমবি অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরাসরি সীমান্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করছে।
র্যাব সূত্র মতে, প্রায় ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ৩০০ সদস্য জামিনে মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে ১৯২ জন জেএমবি এবং ৭২ জন হুজির।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ৯১ জঙ্গি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছে। র্যাব সূত্র জানায়, এর মধ্যে ২০ জন ভয়ংকর। তারা হলো- ফারুক, শফিক, মিলন, সবুজ, সাজেদুর, মানিক, মজিদ, কফিল উদ্দিন ওরফে রব মুনশী, আজিবুন ইসলাম, শাহান শাহ, হামিদুর রহমান, বজলুর রহমান, বাবর, শরিফ, খায়রুল ইসলাম, নাদিম, ময়েজ উদ্দিন, তিতুমির এবং ওয়ালিউল্লাহ হামিদ।
এলিট ফোর্স র্যাব জেএমবি নেতাদের মধ্যে বোমা মিজানকে সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে। বোমা মিজান জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার ছিল। ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলায় বিস্ফোরিত অধিকাংশ বোমা তার তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল। শায়খ আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল মিজান।
২০০৯ সালের ১৪ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের তালতলা মার্কেট এলাকা থেকে বোমা মিজানকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরের দিন পীরেরবাগ থেকে তার স্ত্রী শারমিন আখতার লতাকেও গ্রেফতার করা হয়। লতাকে গ্রেফতারের অভিযানের সময় র্যাব সদস্যকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া গ্রেনেডে তার ডান হাতের কব্জি উড়ে যায়।
তাদের দু’জনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাপক পরিমাণ বিস্ফোরক বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনাতে জেএমবি বিপদজনকভাবে নিজেদের সংগঠিত করার ব্যাপারটি প্রকাশ পায়।
শেষ হয়নি এখনও বিচার
২০০৫ সালের ১৭ আগসেটর হামলায় দুইজন নিহত এবং প্রায় ৪ শতাধিক লোক আহত হয়।
নয় বছর পার হয়ে গেলেও সিরিজ বোমা হামলায় জেএমবি সদস্যদের বিচার শেষ হয়নি এখনও।
গোয়েন্দাদের মতে, হামলার ঘটনায় দায়ের করা ৩২২ মামলার মধ্যে পুলিশ ২৮৯ টির অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। জেলা আদালত ১০২ টি মামলার রায়ে ৩৫ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড, ১৩১ জনকে যাবজ্জীবন এবং বিভিন্ন মেয়াদে ১৮৪জনকে জেএমবি সদস্যকে কারাদণ্ড প্রদান করেছেন।
মোট মামলার মধ্যে ১৭৪টি বিচারাধীন থাকলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ২৫টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত এখনও শেষ করতে পারেনি পুলিশ।
দেশে শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে জেএমবি আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলার মধ্য দিয়ে সংগঠনটি বিধ্বংসী জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে। সে বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।
প্রথমে তারা দেশের বিচার বিভাগকে টার্গেট করে। ৩৮টি হামলায় বিচারক, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষসহ অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়।
২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর জেএমবি সদস্যরা ঝালকাঠিতে সোহেল আহমেদ চৌধুরী এবং জগন্নাথ পাড়ের ওপর বোমা হামলা করে। এসময় পুলিশ জেএমবি সদস্য ইফতেখার হাসান আল মামুনকে হাতেনাতে আটক করে।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জেএমবি প্রধান আব্দুর রহমান, সংগঠনটির অপারেশন প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং আরও ৫জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ছয়জনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। তাছাড়া, বিভিন্ন মামলায় ৩৫ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডাদেশ হাইকোর্টের বিচারাধীন রয়েছে। বেঙ্গলিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম ডেস্ক