শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > রেলের মরণফাঁদ ॥ জীবিকার টানে জীবনের ঝুঁকি

রেলের মরণফাঁদ ॥ জীবিকার টানে জীবনের ঝুঁকি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
তেজগাঁও-কমলাপুর: সকাল আটটা ২০ মিনিটে এফডিসি সংলগ্ন কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ে ক্রিং ক্রিং বেল। গেটম্যান আবু আহমেদ হাতল ঘুরিয়ে প্রতিবন্ধকবার নামালেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কমলাপুর থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে হুইসেল বাজিয়ে চলে গেল ‘মহুয়া এক্সপ্রেস’।

মহুয়া চলে যাওয়ার ৩০ সেকেন্ড আগে রেল লাইনে দৌড়াদৌড়ি করছিল বস্তির শিশুরা। পাশাপাশি সমান্তরালে শুয়ে থাকা দুটি লাইনের ৮/১০ ফুটের মধ্যে অবৈধ বস্তির ছাউনি। ট্রেন চলে যাওয়ার সময় ছুঁই ছুঁই করে যেন।

আটটা ৩৫ মিনিটে আবারো হুইসেলের শব্দ। এলো কর্ণফুলি এক্সপ্রেস। গন্তব্য কমলাপুর-চট্টগ্রাম। মৎস্য আড়ৎ মসজিদের পাশে এক দিন আগে যেখানে দুর্ঘটনায় পাঁচজন মারা পড়েছে, তার ঠিক পাশেই বরফ বিক্রি করছিল রফিক। সেখানে মানুষের জটলা। এরই মাঝে এলো ‘লাল বাহিনী’। বস্তির বাড়তি অংশে শুরু হলো লোহার রড, রামদা’র এলোপাতাড়ি কোপ।

রেল পুলিশ, রেল স্টেট কর্মকর্ত-কর্মচারী আর উৎসুক জনতার ভিড় রেল লাইনের উপর। পৌনে ন’টায় চট্টগ্রাম থেকে ‘ওয়ান ডাউন এক্সপ্রেস’ ধুলো উড়িয়ে লাইন কাঁপিয়ে গেল কমলাপুর। চলছিল উচ্ছেদ অভিযানও।

৯টা ৫ মিনিটে কমলাপুর ছাড়ল আরো একটি ট্রেন। এর মিনিট ১০ এর মধ্যে পরবর্তী ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে গন্তব্যে ছুটলো।

তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল ইসলাম ৮ জনের দল নিয়ে ডিউটি করছেন রেল লাইনে।

‘প্রতিদিনই ডিউটি থাকে। কী করব? কথা শোনে না। আবারো দোকান বসে’, বলছিলেন এসআই আশরাফুল।

ডিআইটি দুই নম্বর মার্কেট ভেঙে ফেলার পর লাইনের উপর বাজার বসে, বলেন কারওয়ান বাজার মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ী দিলীপ রায়। উপরে বিক্রি বেশি, তাদের চাঁদা দিতে হয়।

সাড়ে নয়টা এবং নয়টা ৪০ মিনিটে আরো দুটি ট্রেন চলে গেল এই লাইন ধরে। রেলের ঢাকা বিভাগীয় স্টেট কর্মকর্তা নুরন্নবী কবীর ও রেলের বিভাগীয় প্রকৌশলী লিয়াকত শরীফ নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উদ্ধার অভিযানে।

তারা ব্যস্ত থাকায় কথা হয় তাদের একজন সহকারীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করে তিনি জানান, রেল লাইনের দুই পাশে ২০ ফুট করে ফাঁকা রাখার নিয়ম। কিন্তু লাইন ঘেঁষেই অবৈধ বস্তির সীমানা।

আগামী নভেম্বরে ঢাকা-চট্টগাম রেল লাইন নির্মাণ কাজ শুরু হলে ২০ ফুট ফাঁকা থাকবে বলে দাবি তার।

এই ফাঁকে কথা হয় দুই যুগ থেকে বস্তিতে বাস করা আক্তার হোসেনের সঙ্গে। ‘সকালে ভেঙে বিকেলে বানাই’। উচ্ছেদের পরই যে তারা আবার অবৈধ বসতি গড়ে তোলেন তা স্পস্ট হয় তার কথায়।

আক্তার বলেন, এফডিসি থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার মানুষ বস্তিতে বাস করে।

ক্ষমতাসীন সরকারের নেতা পরিচয় দিয়ে বস্তির নিয়ন্ত্রণকারী এবং রেলের উপর বসা অবৈধ মাছের বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী ‘কমান্ডর সিরাজ মিয়া’ টাকা নিয়ে তাদের থাকতে দেন।

বস্তির নিয়ন্ত্রণে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল হক, শ্রমিক লীগ নেতা কাশেম, যুবলীগ নেতা লোকমান, ট্রাক স্ট্যান্ডের নেতা মকবুল চেয়ারম্যানের নাম কানে আসে বস্তিবাসীর মুখ থেকে। তবে এই নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম মেলেনি।

সকাল ১০টার দিকে এফডিসির গেটে বুলডোজার এলে শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। বুলডোজার দেখে চোখে জল আসে ভাঙারির দোকানি বাবুলের।

চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে মকবুল চেয়ারম্যান ভাড়া দিয়েছেন। তাকে প্রতিদিন ১২০ টাকা দিতে হয়। তিন ছেলে-মেয়েকে বড় করার স্বপ্নে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় এসে ভাঙারির দোকান করেছি।

অল্পক্ষণেই বুলডোজার গুঁড়িয়ে দিলো বাবুলের স্বপ্ন।

উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে থাকা নুরুন্নবী কবীর জানান, এফডিসি থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত তাদের এই অভিযান। আবারো বসলে কী করণীয়- জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দেননি।

কথার ফাঁকে চলে যায় আরো কয়েকটি ট্রেন।

বেলা সাড়ে ১১টায় মগবাজার রেল গেট। ২০/২২ বছর ধরে গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আমিরুল ইসলাম। এফডিসি থেকে এই ক্রসিং পর্যন্ত লাইনের দু’পাশে ফাঁকা। নিশ্চিন্তে দায়িত্ব পালন করতে পারেন তিনি। আমিরুল পতাকা হাঁকালেন, চলে গেল একটি ট্রেন।

মগবাজার, মালিবাগ, খিলক্ষেত এলাকায় লাইনের উপর বাজার বেশি বসে বলে জানান রেল নিরাপত্তাকর্মীরা।

পৌনে ১২টায় মালিবাগ রেল ক্রসিং। দায়িত্বরত গেটম্যান হাবিব জানালেন, সুরমা মেইল চলে গেল গন্তব্যে।

ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজতে ১০ মিনিট বাকী থাকতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে চলে গেল একটি লোকাল ট্রেন। হাবিব জানান, দিনে অন্তত ৪০/৪৫টি ট্রেন যাওয়া আসা করে। তিন শিফটে তারা দায়িত্ব পালন করেন। তার জানা মতে, সম্প্রতি তেমন বড় দুর্ঘটনা এখানে ঘটেনি।

১২টা বাজার আগে খিলগাঁও ক্রসিংয়ে পৌঁছে দেখা গেল- দুই রেল লাইনের মাঝে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছেন আব্দুল্লাহ। রেল লাইন ঘেঁষে আরো ৫/৬টি তরকারির দোকান। ১২টা ৫ মিনিটে চলে গেল জয়ন্ত্রিকা এক্সপ্রেস। পঞ্চাশোর্ধ আব্দুল্লাহ আঁটসাট হয়ে বসে থাকলেও পাশের দোকানিরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়।

ট্রেন চলাচলে ভয় লাগে না? প্রশ্ন করলে আব্দুল্লাহ বলেন, মনের ভয় নেই। পেটের জন্য ভয় লাগে না।

শরিয়তপুরের এই ব্যক্তির চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার, ভাল বেচাকেনা হয় বলে ঝুঁকি নিয়ে এখানে বেচাকেনা।

১২টা ১০ মিনিটে জামালপুর থেকে এলো আরো একটি ট্রেন। এর আগে প্রতিবন্ধকবার বসিয়ে গেটম্যান মুজিবুর পতাকা নিয়ে পাহারায়।

‘সরকারি জমি, যার ইচ্ছা দোকান দিক। কিছু বললে ওদের বাবারা আমাদের উপর রাগ ঝাড়বে। তাই কাউরে কিছু কই না’- আক্ষেপ করে বলেন গেটম্যান মুজিবুর।

তবে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া অনেককে নিজ হাতে উদ্ধার করেছেন বলে দাবি করেন এই গেটম্যান। তার কাছে দুর্ঘটনার কারণ অসাবধানতা।

মালিবাগ রেলগেট এলাকায় রেল লাইনের উপর সারি সারি কাঁচা বাজার। ক্রেতারাও উপস্থিত। ১২টা ৩৫ মিনিটে একটি ডেমু ট্রেন ছুটল কমলাপুরে। দুই লাইনের মাঝে কাঁচা বাজারের দোকানিরা থাকলেও সরে গেল ক্রেতারা। এসময় লাঠি হাতে বা বাজিয়ে কয়েকজন ক্রেতাকে তাড়াচ্ছিল।

রেল লাইনের মাঝে ঝুঁকি নিয়ে তরকারি বিক্রি করা লিটন জানান, প্রতিদিন ২৫০ টাকা দিয়ে বসতে হয় এখানে। বাঁশিওয়ালা, নাইটগার্ড মিলে এই খরচ পড়ে।

দুর্ঘটনার ভয় কিংবা কোন অসুবিধা হয় না?- প্রশ্নে লিটন বলেন, অনেক দিন দোকান করি, বাঁচতে তো হবে। মরলে কিছু করার নেই। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম