শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > রাজাকারের হাতে পতাকা : দায় নেবে কে

রাজাকারের হাতে পতাকা : দায় নেবে কে

শেয়ার করুন

কাজী সিরাজ
ঢাকা : দেশের দুই প্রধান দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ-প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া একে অপরের বিরুদ্ধে খিস্তি-খেউড় করেই চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই একটি কথা বলেন, বেগম খালেদা জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের জাতীয় পতাকায় শোভিত করেছেন। অভিযোগ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অষ্টম সংসদ নির্বাচনের পর যে সরকার বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল তাতে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং একই দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। তাদের গাড়ি-বাড়িতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা উড়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়ি-বাড়িতেও পতাকা দিয়েছিলেন বেগম জিয়া। সা.কা. চৌধুরী মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি অবশ্য এরশাদ সরকারেও মন্ত্রী হয়ে পতাকা উড়িয়েছিলেন। এরশাদ আরও কয়েকজনকে দিয়েছিলেন জাতীয় পতাকা। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত-উদ্ভাসিত মানুষের কাছে তা ছিল মর্মজ্বালার বিষয়। একাত্তরের রাজাকার-আলবদর-আলশামস এবং তাদের চিন্তা-চেতনার বর্তমান অনুসারীরা ছাড়া দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শেখ হাসিনার এই সমালোচনাকে যথার্থ মনে করে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই সমালোচনার জবাবে তার অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই হয়তো ১ ডিসেম্বর জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রসঙ্গটির অবতারণা করে বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আন্দোলন ও নির্বাচন ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময় মিথ্যাচার করে, যুদ্ধাপরাধীদের হাতে বিএনপি নাকি জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগই প্রথম রাজাকারদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছে।’ বেগম খালেদা জিয়ার এ বক্তব্যকেও মিথ্যা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় সে ব্যাপারে মতভেদ আছে। দুই নেত্রীর দুই সরকারের আগেও শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং আবদুল আলিম মন্ত্রী হয়েছিলেন। শাহ আজিজের বিরুদ্ধে অবশ্য জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া এখন পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অন্য কোনো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ জোরালো নয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে অন্য কয়েকজনসহ তিনি কারাগার থেকে মুক্তিও পেয়েছিলেন দালাল আইনে সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত অন্য বন্দীদের কারামুক্তির আগেই। এই নিবন্ধের আলোচনা জিয়া-এরশাদের আমল নিয়ে নয়; হাসিনা-খালেদার আমল নিয়ে। তাই শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়ার বক্তব্য বিশ্লেষণের আগে রাজাকার-আলবদরদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের দুজনের মধ্যে ফার্স্ট ও সেকেন্ড পজিশনটা কার তা নির্ধারিত হওয়া দরকার। এটা সবাই জানেন যে, দুই নেত্রীর মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়া ও সরকার গঠন করার ব্যাপারে ফার্স্ট বা এক নম্বর। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সেকেন্ড বা দুই নম্বর। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে এবং শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা সময়ের ব্যাপার এমনটাই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু জনগণ সিদ্ধান্ত দিয়ে দিল সম্পূর্ণ উল্টো। কেউ কেউ এমন আগাম মন্তব্যও করেছিলেন, বেগম জিয়ার দল ৬০-৭০ আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসতে পারে। ভারত সফরে গিয়ে শেখ হাসিনা তো বিএনপিকে দিয়েছিলেন আরও কম। তিনি বলেছিলেন, বিএনপি বড়জোর ২০টি আসন পেতে পারে। নির্বাচনের পর দেখা গেল বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি পেল ১৪০ আসন আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ পেল ৮৮ আসন। এরশাদের জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ৩৫ আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ১৮ আসন। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল না। সরকার গঠন নিয়ে সংকট সৃষ্টি হলো। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ লাগিয়ে দিলেন আরেক ‘ফেরকা’। তিনি বললেন, ‘সংসদে কে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’ যেদিন তিনি এমন সংশয়াচ্ছন্ন ও রহস্যপূর্ণ বক্তব্য দিলেন তার পরদিনই জিরো পয়েন্টে ত্বরিত আয়োজিত এক জনসভায় বেগম জিয়া জবাবে বললেন, ‘আমি জাস্টিস সাত্তার নই। সরকার গঠন নিয়ে টালবাহানা সহ্য করা হবে না। কে যে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেব।’ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ‘মারফতি’ বক্তব্যে সর্বত্র এমন একটা ধারণা ছড়িয়ে পড়ল যে, আওয়ামী লীগ বুঝি বা তাকে এমন মেসেজ পাঠিয়েছে, পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবে। দুই দলের সঙ্গে তাদের আলাপ-সংলাপ চলার কথাও বাজারে রটেছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলকে সরকার গঠনের জন্য সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী আমন্ত্রণ না জানিয়ে যখন ধূম্রজাল সৃষ্টি করলেন তখন জনগণও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগল এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সঙ্গে সরকার গঠনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একটা সমঝোতার আলোচনা হয়েছে বা হচ্ছে বলে বিশ্বাস করতে চাইল। যদি তা হয়ে যেত তাহলে রাজাকার-আলবদরের হাতে পতাকা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে ১৯৯১ সালেই ফার্স্ট হয়ে যেতেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তা হয়নি। সরকার গঠনে জামায়াত সমর্থন করল বিএনপিকে, বেগম খালেদা জিয়াকে। বিনিময় চুক্তি হলো দুটি সংরক্ষিত মহিলা আসনের। বিএনপি দুটি আসন ছেড়ে দিল জামায়াতকে। মন্ত্রিসভা গঠন করে বিএনপি। সেবার জামায়াতীদের হাতে জাতীয় পতাকা দিতে হয়নি। তবে এটা সত্য, শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় যাদের নাম বেগম জিয়া উল্লেখ করেছেন একাত্তরে তাদের ভূমিকা বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভাকে ‘আলোকিত করা’ জামায়াত নেতা এবং আলবদর বাহিনীর সংগঠক হিসেবে চিহ্নিত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পর্যায়ের ছিল না। একাত্তরে রাজাকারের চেয়ে আলবদর-আলশামসরা ছিল অধিকতর ভয়ঙ্কর। এটা সবাই স্বীকার করেন। আলবদররা একাত্তরের ভুল তো স্বীকার করেই না বরং তারা ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বলে একাত্তরে তারা যা করেছে তা সঠিক ছিল। পাকিস্তানিরা এখনো এদের তাদের লোক মনে করে, দাবি করে। অতিসম্প্রতি এক জামায়াত নেতার ফাঁসির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রমাণ করে জামায়াতের ওই সব নেতা এখনো বুঝি প্রকৃত বাংলাদেশি হননি। নইলে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের ‘আমাদের লোক’ দাবি করেন কী করে? আগেই উল্লেখ করেছি, এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অভিযোগ মিথ্যা নয়। জনগণও তা জানে। এমনকি বিএনপির অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে বিশাল ও মূলশক্তি তারাও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত বলে শোনা যায়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথাবার্তায় তা বেরিয়েও আসে। কিন্তু ‘চাকরি’ হারানোর ভয়ে কেউ কিছু বলেন না প্রকাশ্যে।
দুজনের অভিযোগই তাৎপর্যপূর্ণ এবং তাৎপর্যটা একই। তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এর অন্তর্নিহিত যে সত্যটি স্পষ্ট হয়, তা হলো স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের হাতে আমাদের ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া শুধু ছোটখাটো অন্যায় নয়, গর্হিত এক অপরাধ। এ অপরাধ দুজনের কেউ-ই অস্বীকার করতে পারেন না। বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত অভিযোগ উত্থাপন করে এই প্রথম প্রচ্ছন্নভাবে নয়, পরিষ্কারভাবে প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন, রাজাকারদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়ার কাজটি সঠিক কাজ হয়নি। যেহেতু একই কাজ আরও উচ্চমাত্রায় তিনিও করেছেন তাই শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন, তারও ভুল স্বীকার করা উচিত। জাতির কাছে অনুতপ্ত হয়ে বলা উচিত ‘আমিও ভুল করেছি’। আর তার বক্তব্যটি যদি আন্তরিক হয়, যা বলেছেন তা যদি সত্যিকারভাবে ‘মিন’ করেন, তাহলে তার কাছ থেকে জাতি এটাও প্রত্যাশা করতে পারে, এখন থেকে তিনিও রাজাকারদের ‘না’ বলবেন। বেগম খালেদা জিয়া তার বক্তব্যটি রেখেছেন তার দলের সহযোগী সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতাদের সামনে। মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত এবং সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খান দুজনই প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা, রাজাকার-আলবদর-আলশামসের ভূমিকা তাদের অজানা নয়। তাদের নেত্রীর বক্তব্যের অন্তর্নিহিত সুর তাদের হৃদয়েও নিশ্চয়ই অনুরণিত হয়েছে। এতদিন তারা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য কী করে হজম করলেন সে প্রশ্ন এখন করে আর লাভ নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের এই অসীম সাহসী গেরিলা যোদ্ধাদের কাছ থেকে এটা কী আশা করা যায় যে, এবার থেকে রাজাকারদের ‘না’ বলার ব্যাপারে তাদের নেত্রীর ওপর প্রভাব বিস্তারে তারা সাহসী হবেন? তা না হলে কোনো মুক্তিযোদ্ধা-সহযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো লোক যদি তাদের প্রশ্ন করে, কী করে রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে একই মিছিলে, সভা-সমাবেশে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শরিক হচ্ছেন, কী জবাব দেবেন তারা? ভোটের জন্য যদি জামায়াতের এত দরকার হয়, জোট ভেঙে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব তো অন্তত দিতে পারেন!
বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে ‘বিএনপি’র নির্বাচন ছাড়া কোনো সম্পর্ক নেই কথাটা আগে এতটা স্পষ্ট করে কখনো বলেননি। বলেছেন মৃদুকণ্ঠে। তবে রাজাকারদের হাতে পতাকা তুলে দেওয়ায় খারাপ, অনৈতিকতার বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী বক্তব্য আগে এভাবে কখনো দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। এমন বক্তব্য এমন এক সময়ে তিনি দিয়েছেন, যখন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকারের তলে তলে একটা আঁতাত বা সমঝোতার গুঞ্জন রাজনৈতিক বাজারে চাউর হয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হচ্ছে, দলের অস্তিত্ব ও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন অটুট রাখার জন্য সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে জামায়াতে ইসলামী। তারা ২০ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে যেটুকু যোগাযোগ না রাখলেই নয়, বিএনপির সঙ্গে সেটুকু যোগাযোগই শুধু রাখছে। সম্পর্কের নিবিড় বন্ধন এখন আর আগের মতো দৃঢ় নেই। সম্পর্ক এখন অনেকটাই ফরমাল, শিথিল ও শীতল। তবে সম্পর্কের উষ্ণতা যাচ্ছে সরকারি দলের সঙ্গে। গোলাম আযমের ঘটা করে জানাজার আয়োজনে সরকারি সহযোগিতা, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গোলাম আযম পুত্রের জাতিকে জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, একাত্তরে গোলাম আযম ভুল করেছিলেন স্বীকার করে ছাত্রশিবিরের বিবৃতি, জামায়াত নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে লীগ সরকারের ধীরে চলো নীতি এবং জামায়াতে ইসলামীর জন্য আরও কিছু ‘স্বস্তিদায়ক’ বিষয় থেকে মানুষের মধ্যে সরকার-জামায়াত সমঝোতার বিষয়টি অনেকটাই বদ্ধমূল। জামায়াত দুই দিকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বলে ৩ ডিসেম্বরের দৈনিক কালের কণ্ঠেও খবর বেরিয়েছে। কাজেই বেগম জিয়ার মুখে রাজাকারবিরোধী বা রাজাকার-বিদ্বেষী বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণই বটে।
আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে একটা চতুর খেলা খেলছে বলে মনে হয়। তাদের প্রধান লক্ষ্য বিএনপিকে দুর্বল করা, ঘায়েল করা। তাদের ধারণা, ২০ দলীয় জোট ভেঙে জামায়াতে ইসলামী বেরিয়ে গেলে বিএনপির ‘বিষদাঁত’ ভেঙে যাবে, আন্দোলনের সাহস ও সামর্থ্য কোনোটাই থাকবে না। তাই কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বের করে আনার লক্ষ্যে তারা কাজ করতে পারে। জামায়াতের এ মুহূর্তে যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্য নেই, তারা দল, দলের শক্তি এবং দলের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য রক্ষায় সরকারের সঙ্গে একটা আঁতাত গড়তেই পারে। বিএনপির ক্ষতি হলে জামায়াতের কী ক্ষতি? জামায়াত যা করে নিজের লাভের জন্যই করে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা বা সমঝোতার প্রয়াসও সরকারের চূড়ান্ত স্বার্থে নয়, তাদের নিজেদেরই স্বার্থে। তারা এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচন করলে লীগ সরকারের তাৎক্ষণিক একটা লাভ হয়তো আছে, কিন্তু চূড়ান্ত লাভ জামায়াতের। তারা রক্ষা পেল, বেঁচে গেল।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ- উভয়েরই এখন এই উপলব্ধি করার বোধহয় সময় এসেছে যে, জামায়াত আওয়ামী লীগ-বিএনপি কারও নিজস্ব শক্তি নয়। বরং উভয়ের জন্যই গলার কাঁটা। দুই দলের রাজনীতি ও আদর্শে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও (মৌলিক কোনো পার্থক্য আসলে নেই) জামায়াতের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে দুই দলেরই পার্থক্যটা আদর্শিক ও মৌলিক। কাজেই উভয়েরই উচিত এখন এই কথা বলা, ‘এনাফ ইজ এনাফ’, আর নয়। রাজাকারদের এবার স্পষ্টতই ‘না’। বেগম জিয়ার তো বলাই উচিত। কেননা, এ ব্যাপারে তার বদনাম বেশি।
একটি ব্যাখ্যা : ৩০ নভেম্বর রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই কলামে প্রকাশিত লেখায় বিএনপি সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক দুটি অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে লিখেছিলাম, গত উপজেলা নির্বাচনে নরসিংদী জেলা বিএনপি যাদের সমর্থন করেছিল তারা জামানত হারিয়েছে এবং যারা জিতেছে এবং ভবিষ্যতেও জেতার সম্ভাবনা আছে, তারা বিএনপির সাবেক মহাসচিব মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার ভাবশিষ্য এবং বর্তমানে মান্নান ভূঁইয়ার আরেক সহযোদ্ধা, সাবেক এমপি সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুলের ঘনিষ্ঠ। বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের কর্তাদের কাছে তাদের কোনো মূল্য নেই, যারা হেরেছে তাদেরই কদর বেশি তাদের কাছে। জেলার দু-চারজন পরিচিত নেতা জানিয়েছেন, তাদের সব প্রার্থী জামানত হারায়নি। সদরে জিতেছে এবং শিবপুরে দ্বিতীয় হয়েছে। সবার জামানত হারানোর তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক না হওয়ায় দুঃখিত। তবে তারা শিবপুরে হেরেছেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের কাছে, বেলাবোতে হেরেছেন সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুলের সমর্থিত প্রার্থীর কাছে। রায়পুরায় বকুলের সমর্থিত প্রার্থী হাজার দেড়েক ভোটে হারলেও বিএনপি প্রার্থীর খবর ছিল না। বিএনপি ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকলে জামায়াত ছাড়াই কেমন শক্তিশালী হতে পারে কুমিল্লা জেলার সঙ্গে তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতেই নরসিংদীর প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছি। আমি বিএনপির সাংগঠনিক ডিসিপ্লিনের কেউ নই, নরসিংদী থেকে নির্বাচনও করব না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র ও জনগণের পক্ষে বিএনপিও একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করুক, অনেকের মতো আমিও তা প্রত্যাশা করি। কোনো কোনো লেখায় আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গও আসে। জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দুর্বলতা থাকলে জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লেখার উদ্দেশ্য তা-ই থাকে।
গুলশান অফিসের ব্যাপারেও আমার কোনো ব্যক্তিগত উৎসাহ নেই। বিভিন্ন সময় সেই অফিস সম্পর্কে মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যই আমার মন্তব্যের সূত্র। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, মোসাদ্দেক আলী ফালু যখন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সহকারীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন বেগম জিয়া যে অফিসেই বসতেন না কেন, নেতা-কর্মীদের কোনো অভিযোগ শোনা যেত না। বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে মোসাদ্দেক আলী ফালুকে ‘জমা-খরচ’ দিতে হয়েছে বা কোনোভাবে তুষ্ট করতে হয়েছে এমন কথাও শোনা যায়নি। নেত্রীর সঙ্গে প্রয়োজনে যারা দেখা করতে যেতেন তারা কোনো বাধার মুখে পড়তেন না। কখনো কোনো সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলেও মোসাদ্দেক আলী ফালুর কাছ থেকে সন্তুষ্টচিত্তেই সবাই বিদায় নিতেন। কোনো নেতা-কর্মীর মুখে তার কোনো বদনাম এখনো শোনা যায় না। এখন কিন্তু দারুণ অসন্তোষ। আমার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত সুর ছিল, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়ার অফিসে মোসাদ্দেক আলী ফালুর মতোই একজন বিশ্বস্ত ও অনুগত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রকৃত অর্থেই বিএনপির নিজস্ব লোক। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আমি কোনো চাকরি প্রার্থী নই। আমার অন্য কোনো হীনস্বার্থও নেই। আশা করি আমি আমার বক্তব্যের মূল সুরটি ব্যাখ্যা করতে পেরেছি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।