শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > রাজধানী যানজটমুক্ত রাখতে মহাপরিকল্পনা অকেজো

রাজধানী যানজটমুক্ত রাখতে মহাপরিকল্পনা অকেজো

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানী যানজটমুক্ত রাখতে ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন মহাপরিকল্পনার (এসটিপি) কোনো অগ্রগতি হয়নি ৯ বছরেও।

তদারকি করার জন্য নির্ধারিত কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় এবং যথাযথ সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পের প্রথম ধাপের অনেক কার্যক্রমই আলোর মুখ দেখেনি। ফলে এসটিপি অকেজো হয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, রাজধানী ও এর প্রবেশমুখগুলো যানজটমুক্ত করতে ২০০৪ সালে ২০ বছর মেয়াদি (২০০৫-২০২৪) মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার। ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রণীত এসটিপি বাস্তবায়নে এরইমধ্যে ৯ বছর কেটে গেছে।

এসটিপির আওতায় চার পর্বে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি বেশকিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়। চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে নতুন বেশকিছু প্রকল্প যুক্ত করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

এই মহাপরিকল্পনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৫০টি নতুন সড়ক নির্মাণ, এক রুটে একটি বড় কোম্পানির বাস পরিচালনার ব্যবস্থা বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ (বিআরএফ) প্রবর্তন, বাসের জন্য পৃথক লেন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), মেট্রোরেল বা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) ও ফ্লাইওভার এবং বৃত্তাকার নৌপথ প্রবর্তন ও স্বল্প দূরত্বের রেল সার্ভিস চালু করা।

এছাড়া রাজধানীর প্রধান সড়ক রিকশামুক্ত ও ফুটপাত দখলমুক্ত করা, নগরীতে মানুষের চাপ কমিয়ে আনতে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশও করা হয় ওই পরিকল্পনায়। এসটিপি অনুসরণ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঢাকা মহানগরীসহ আশপাশের জেলাগুলোর জন্য ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটারজুড়ে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নও অন্তর্ভুক্ত। এসটিপির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিলাসবহুল কিছু প্রকল্প প্রণয়ন করা হবে।

এসটিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিআরএফ শুরুতেই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু সড়ক রিকশামুক্ত করা গেলেও প্রতিদিন বাড়ছে রিকশার সংখ্যা। ফুটপাত ক্রমে বেদখল হচ্ছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন যাচাই-বাছাইয়ে এসটিপির উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকও হয় না গত ছয় বছর ধরে। পাঁচ বছর অন্তর এসটিপি পর্যালোচনা করার সুপারিশ করা হলেও তা হয়নি।

এসটিপি অনুযাযী, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বিআরটি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নির্মাণ এবং মেট্রোরেলের নীতিমালা প্রণয়নের কথা ছিল। বিআরটি এখনও শুরু করা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের চার বছর পর মেট্রোরেলের নীতিমালা চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে সরকার। একই সঙ্গে ৩৩০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও বিআরএফ প্রবর্তন কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া প্রথম পর্বে তেজগাঁও-এয়ারপোর্ট টানেল, মেরুল বাড্ডা-গোলাকান্দাইল সড়ক, টঙ্গী-ঘোড়াশাল সড়ক, ঢাকা বাইপাস, মালিবাগ-জনপথ সড়ক, রমনা স্টার গেট-নটরডেম কলেজ সড়ক নির্মাণের কথা ছিল। এগুলোর কোনোটিরই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

দ্বিতীয় পর্বের আওতায় জিয়া কলোনি-মিরপুর সড়ক, বিজয় সরণি-শহীদ তাজউদ্দিন সরণি, পান্থপথ-রামপুরা সড়ক সম্পন্ন হলেও খিলগাঁও-টঙ্গী সড়ক, সারকুলার রিং রোড, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড-বেড়িবাঁধ সড়ক, শিয়া মসজিদ-বেড়িবাঁধ সড়ক, আজিমপুর-বেড়িবাঁধ সড়ক, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টর-বেড়িবাঁধ সড়ক, মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশন (সাগরিকা)-বনানী সড়ক, পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ, যাত্রাবাড়ী-পোলার রোড সড়ক ও পল্লবী-বেড়িবাঁধ সড়ক ইত্যাদি কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া বিআরটি সম্প্রসারণ, মেট্রোরেল নকশা প্রণয়ন (২০১০-২০১৪) এই পর্বে সম্পাদন করার কথা ছিল; যার কোনোটিই হয়নি।

তৃতীয় পর্বে (২০১৫-২০১৯) আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন, আশুলিয়া-আরিচা সড়ক, খিলক্ষেত-ইস্টার্ন বাইপাস সড়ক, ইস্টার্ন বাইপাস-ঢাকা বাইপাস সড়ক, কোনোখোলা-হযরতপুর সড়ক, বাসাবো-বালু নদী সড়ক, মোহাম্মদপুর-কেরানীগঞ্জ সড়ক, ইস্টার্ন বাইপাস, জিগাতলা-হাজারীবাগ সড়ক, ওয়েস্টার্ন বাইপাস, বিরুলিয়া-আশুলিয়া সেতু, ঢাকা লিঙ্ক রোড, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা ঘাট সড়ক নির্মাণ যথাসময়ে শুরুর কোনোই উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

এ মেয়াদে বিআরটি আরও সম্প্রসারণ ও মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক সকল কাজ সম্পাদন ও নির্মাণ শুরুর কথা রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই সরকার মুক্তারপুর সেতু, বসিলায় বুড়িগঙ্গা সেতু ও বালু নদীতে সেতু নির্মাণ করেছে ও মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

চতুর্থ পর্বে (২০২০-২০২৪) হযরতপুর-হেমায়েতপুর সড়ক, ফতুল্লা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক, হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ সড়ক, বিডিআর এলাকায় অযান্ত্রিক গাড়ির জন্য সড়ক, প্রগতি সরণি-বালু নদী সড়ক, মতিঝিল-কমলাপুর সড়ক, পল্লবী-উত্তরা তৃতীয় পর্ব সড়ক, মোহাম্মদপুর-মিরপুর সড়ক, কৃষি মার্কেট- পশ্চিমাঞ্চলীয় বাঁধ সড়ক, মিরপুর চিড়িয়াখানা-বেড়িবাঁধ সড়ক, উত্তরা ৮ ও ৪ নম্বর সেক্টর থেকে বালু নদী পর্যন্ত দুটি সড়ক, সাভার ইপিজেড-ওয়েস্টার্ন বাইপাস, বুড়িগঙ্গা প্রথম ও দ্বিতীয় সেতুর মধ্যে সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি। গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকল্পের মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা সময়মতো পাওয়া গেলে মেট্রোরেল সম্পন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না।

রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জের বৃহৎ এলাকাজুড়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে মহাপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করা হয়।

এসটিপি বাস্তবায়নকালে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩২ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটিই এসটিপি প্রণয়নকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান লুইস বার্জার গ্রুপ ইনকরপোরেটেড ও বাংলাদেশ কনসালটেন্ট লিমিটেডকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। আর সর্বশেষ এসটিপি উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হয়েছিল ২০০৭ সালে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও এসটিপি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. শামসুল হক বলেন, ‘গণমানুষের কথা মাথায় রেখে এসটিপি প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সুপারিশ অনুযায়ী এসটিপি চলছে না। এরই মধ্যে বিআরএফ ভেস্তে গেছে। এ পর্যন্ত যতগুলো স্টাডি হয়েছে প্রতিটিতেই এসটিপি বাস্তবায়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সেসব সুপারিশও কার্যকর করা হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসটিপির সুপারিশকৃত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২০ কোটি ডলার। কিন্তু সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় বর্তমান হিসেবে এ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এছাড়া সকল বিষয়ে যোগাযোগের জন্য নির্ধারিত কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় এসটিপির এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’

যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, রাজধানী যানজট মুক্ত রাখতে যখন থেকে এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, তখন থেকেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এই পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। বাস্তবায়ন কাজের ভিত্তি করে এই মহাপরিকল্পনা আপডেট করার চিস্তাভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।