স্টাফ রিপোর্টার ॥ টানা কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শত শত ঘরবাড়িতে ইতিমধ্যেই পানি ঢুকেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মধ্যাঞ্চলের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। রামপুরা ব্রিজের উত্তর থেকে কুড়িল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার বৃষ্টির পানি, ড্রেন ও স্যুয়ারেজের পানিপ্রবাহের কোনো নির্দিষ্ট খাল বা নালা না থাকায় এই এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। মধ্য বাড্ডা থেকে শুরু করে কুড়িল পর্যন্ত উত্তর বাড্ডা, আনন্দনগর, বাইদারটেক, সাঁতারকুল, নূরেরচালা, ছোলমাইদ, নর্দা, শাহজাদপুর, বড়কাঁঠালিয়া, জগন্নাথপুর, ভাটারা, নয়ানগর, বসুন্ধরা, বারিধারা, গুলশানসহ বিস্তীর্ণ এলাকার পানি যাওয়ার কোনো পথ না থাকায় নিচু ঘরবাড়িগুলো পুরো বর্ষা মৌসুমেই ডুবে থাকে। ফলে নিম্ন আয়ের এসব পেশাজীবী-শ্রমজী বী খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই।
ড্যাপ প্রস্তাবিত কুড়িল-পূর্বাচল সড়কের দু’পাশের খাল দুটি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মধ্য ঢাকার বিশাল এলাকার ভাগ্যাহত এসব মানুষের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ লাঘব হবে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নগর বিশেষজ্ঞ, পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞ এবং রাজউকের কর্মকর্তারা বলেছেন, ড্যাপের গেজেটকৃত নকশা অনুযায়ী কুড়িল-পূর্বাচল সংযোগ সড়কের দু’পাশে দুটি খাল খনন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। কারণ রাজধানী ঢাকার মধ্যাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় দুঃসহ জলাবদ্ধতা এবং লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ দূর করতে হলে এ খাল দুটি নির্মাণের আর কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত খাল খননের কাজ শুরু করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সৃষ্ট স্থায়ী জলাবদ্ধতা দূরীকরণের আর কোনো উপায় নেই। সুতরাং বৃহত্তর ঢাকাবাসীর স্বার্থে এবং খেটে খাওয়া শ্রমজীবী-পেশাজীবী লাখ লাখ নারী-পুরুষের জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণা ও কষ্ট দূর করতে হলে এই খাল খনন করতেই হবে। এটি বাস্তবায়নে আইনগত বাধ্য-বাধকতাও রয়েছে সরকারের জন্য। বিশেষ করে রাজউক তথা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপরই এই খাল বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় এটি এখন তাদের কর্তব্য। নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ড্যাপের যে কয়েকটি ভালো এবং ঢাকা রক্ষামূলক প্রস্তাব ও সমীক্ষা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পূর্বাচল সড়কের দু’পাশে দুটি খাল খনন করা। এর বিরুদ্ধে কতিপয় ভূমিদস্যু, প্রভাবশালী মহল ও ভুঁইফোড় হাউজিং কোম্পানি তাদের নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ড্যাপের প্রস্তাবিত খাল খননের বিরোধিতা করছে। এ বিরোধিতা সরকারের আইনের বিরুদ্ধে এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই সরকারের উচিত, সব ষড়যন্ত্র, বিরোধিতা ও স্বার্থান্বেষী মহলের দিকে না তাকিয়ে ঢাকাবাসীর স্বার্থে অবিলম্বে এ খাল খননের কাজ শুরু করা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রামপুরা-কুড়িল প্রগতি সরণির পূর্ব দিকের বিশাল অঞ্চল আষাঢ়ের মুষলধারার বৃষ্টির পানিতে থইথই করছে। অসংখ্য ঘরবাড়িতে বিশেষ করে টংঘরে পানি ঢুকে পড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়েছে। ভাটারা ও নূরেরচালার ঘরে ঘরেই এখন হাঁটু পানি। ছোলমাইদ, বড় কাঁঠালদিয়া, নয়ানগর, নাপতখোলা, খিলবাড়িরটেক, বাইদারটেক ও জগন্নাথপুরের নারী-পুরুষের অভিযোগ, বৃষ্টি ও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার কোনো খাল বা নালা না থাকায় তাদের এ দুরবস্থা। আগে এসব এলাকায় যেসব নিচু জমি, ডোবা ও নালা ছিল, সেগুলো গত কয়েক বছরে কয়েকটি হাউজিং কোম্পানি ভরাট করে ফেলায় এখন এ এলাকার পানি আর বালু নদীতে গিয়ে পড়তে পারছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় জলাবদ্ধতা, যা সহজে দূর হচ্ছে না। স্থানীদের প্রশ্ন, সরকার কাদের স্বার্থ দেখবে, বড় বড় হাউজিং কোম্পানির না সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষের? এসব ভুক্তভোগী মানুষ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে অবিলম্বে পূর্বাচল সড়ক সংলগ্ন খাল খনন করে জলাবদ্ধতার হাত থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
রাজউক সূত্র জানায়, ১৯৯৫-২০১৫ সালে ১৫২৮ বর্গকিলোমিটারে রাজউক মহাপরিকল্পনার আওতায় প্রণয়ন করা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি)। এরই আলোকে ওই সময়েই প্রণয়ন করার কথা ছিল ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ড্যাপের সমীক্ষার কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালের জুলাই মাসে এবং শেষ হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। রাজউক জানিয়েছে, রাজধানীর ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে প্রগতি সরণির উত্তর প্রান্ত কুড়িল থেকে বালু নদী সংলগ্ন প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩০০ ফুট প্রস্থের জমি রাস্তা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের জুনে সরকার অনুমোদিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ওই সংযোগ সড়কের উভয় পাশে ১০০ ফুট প্রস্থের দুটি খালের সংস্থান রাখা হয়েছে। পরে নানা আপত্তির পর ড্যাপ পর্যালোচনা ও সংশোধনের পর ড্যাপের ম্যাপ ও সমীক্ষা গেজেট করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ওই সময় ঢাকা মহানগরীকে ৫টি অংশে বিভক্ত করে ৫ জন অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি এবং প্রকৌশলীর সমন্বয়ে তৈরি করা হয় ড্যাপ। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে প্রগতি সরণির উত্তর প্রান্ত কুড়িল থেকে বালু নদী সংলগ্ন প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৩০০ ফুট প্রস্থের জমি, রাস্তা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের জুনে সরকার অনুমোদিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) সমীক্ষা ও ম্যাপে দেখা যায়, কুড়িল থেকে পূর্বাচল আবাসিক এলাকার সংযোগের জন্য ৩০০ ফুট রাস্তার দু’পাশে (উত্তর ও দক্ষিণে) ১০০ ফুট করে মোট ২০০ ফুটের দুটি খাল খনন করা হবে। এ খালের মাধ্যমে নগরীর দক্ষিণ ও উত্তর দিকের পানি বালু নদীতে গিয়ে পড়বে। তাছাড়া খালেও পানি সংরক্ষিত থাকবে।
এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোঃ নূরুল হুদা বলেন, একসময় ক্যান্টনমেন্ট, খিলক্ষেত, কচুক্ষেত, নিকুঞ্জসহ আশপাশের এলাকার পানি এখান দিয়েই নেমে বালু নদীতে গিয়ে পড়ত। এটি ছিল লো লায়িং এরিয়া। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ভরাটের কারণে ওই পানি আর এখন নামতে পারছে না। এ কারণে এসব এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ ড্যাপের ম্যাপ ও সমীক্ষায় এখানে রাস্তার দু’পাশে ১০০ ফুট করে ২০০ ফুট খাল খনন করার নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, এখানে জমি অধিগ্রহণ করার মাধ্যমে ওয়াসার মাধ্যমে জলাধার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ খালের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা শহরকে রক্ষার জন্য কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ৩০০ ফুটের রাস্তা এবং রাস্তার দু’পাশে ১০০ ফুট করে দুটি খাল অবশ্যই খনন করতে হবে। সংযোগ সড়ক ও খাল দুটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে রাজউক বলেছে, ৩০০ ফুট সড়কের প্রতি বর্গফুট জায়গা যাতে সঠিক ও সর্বোত্তম ব্যবহার হয় সে জন্য বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সমন্বিত উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্টস লিমিটেড (ইপিসি), এসএআরএম অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড এবং ডাটা এক্সপার্টস (প্রা.) লিমিটেডের মাধ্যমে ড্রয়িং ও ডিজাইন প্রণয়ন-পূর্বক বুয়েটের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের মাধ্যমে যাচাই করা হয়।