আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥
উত্তর ভারতের ছোটগ্রাম মহাবনে সবে রাত নামতে শুরু করেছে। গ্রামের বাসিন্দা গোপি চাঁদ যাদব তার ফসলের ক্ষেতে কম্বল ও টর্চ নিয়ে এসেছেন। ক্ষেতের ভেতর তৈরি করা কাঠের মঞ্চে রাত কাটাবেন তিনি।
রাতজুড়ে তার কাজ হচ্ছে- এলাকায় অজস্র ছাড়া গরুর হাত থেকে ক্ষেতের পাকা সরিষা রক্ষা করা। এসব গরু যাতে ফসলের ক্ষেতে হানা দিতে না পারে, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তা তাড়িয়ে বেড়ানো।
কেবল যাদবই না- রাতের তীব্র শীত উপেক্ষা করে হাজার হাজার চাষি তাদের ফসল বাঁচাতে রাত জেগে পাহারা দেন। না হলে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো এসব গরু এসে তাদের ফসল নষ্ট করে দেবে।
ভারতীয় কৃষকরা এখন উভয় সংকটে রয়েছেন। যে ফসল তারা এত পরিশ্রম করে গরুর হাত থেকে রক্ষা করতে রাত জাগছেন, ইতিমধ্যে তার দাম পড়তে শুরু করেছে।-খবর রয়টার্সের।
যখন ছাড়া গরু শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, গ্রামের অবস্থা তখন আরও ভয়াবহ। কৃষকরা বলছেন, ছাড়া গরুর সংখ্যা এতটাই বাড়ছে যে এগুলো এখন তাদের বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই বিপদের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের নীতিকে দায়ী করছেন তারা।
গরুকে সুরক্ষা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র দায়িত্ব। উত্তর ভারতের জনসংখ্যাবহুল হিন্দি-ভাষীদের মধ্যে গো-রক্ষা কর্মসূচিতে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। এ অঞ্চলকে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রাণকেন্দ্র বলে আখ্যায়িত করা হয়।
তবে শেষ পর্যন্ত তাদের কর্মসূচিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়ই দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু কৃষকরাও অতিষ্ঠ ও বিরক্ত।
নয়াদিল্লি থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরের কাকরিপুর গ্রামের অশীতিপর চাষি বাবুরাও ছাইনি বলেন, ইতিমধ্যে হাজারটা সমস্যা এসে আমাদের ঘিরে ধরেছে। আর সরকার নতুন করে আরেকটি তৈরি করেছে। এই প্রথম গরুর কবল থেকে ফসল রক্ষায় আমাদের রাত জেগে পাহারা দিতে হচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশের মহাবনসহ অন্তত ৯ গ্রামের অর্ধশতাধিক চাষি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিতে তারা অন্তত দুবার ভাববেন। চলতি বছরের মে মাসে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট দেয়া মোদির দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দুটি কারণের কথা তারা জানিয়েছেন। প্রথমত ফসলের ক্ষেতে গরুর হানা। দ্বিতীয়ত উৎপাদিত ফসলের দাম পড়ে যাওয়া।
আগের নির্বাচনে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র উত্তরপ্রদেশের ৮০ আসনের মধ্যে ৭৩ পেয়েছিলেন মোদি। ফসলের উচ্চমূল্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে গ্রামীণ ভোটাররা বিজেপিকে স্বতঃস্ফূর্ত ভোট দিয়েছিলেন। সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে হিন্দু চাষিরা মোদিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনটি রাজ্যে বিরোধী দল কংগ্রেসের কাছে ধরাশয়ী হয়েছে মোদির বিজেপি।
উত্তর ভারতের এ তিন রাজ্যের মানুষের প্রধান অবলম্বনই হচ্ছে কৃষি। কাজেই এ অঞ্চলের সাড়ে ২৬ কোটি কৃষক ও তাদের পোষ্যদের মধ্যে সমর্থন ফিরে পেতে কঠোর চেষ্টা করছেন মোদি সরকার।
দুধ, পনির ও মাখন উৎপাদনে ভারতীয় কৃষকরা গো-পালন করেন। এদিকে গো-হত্যা কিংবা গরুর ক্ষতি করা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে গো-হত্যা বেআইনি বলেই মনে করা হচ্ছে। সেই নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গো-মাংসের বাণিজ্য বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে লাইসেন্স নেই এমন কসাইখানা ও দেশজুড়ে গরু পাচারের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অভিযান চালানো হয়েছে।
একই সময়ে গরু বহনকারী ট্রাকের ওপর হিন্দু গো-রক্ষাকারীদের হামলা বেড়ে গেছে। এতে গরু ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক জন্ম নিয়েছে। আর অধিকাংশ গরু ব্যবসায়ীই হচ্ছেন মুসলমান। ভয়-আতঙ্কে গরু তো ভালো, ষাঁড় ব্যবসায়ীরাও তাদের বাণিজ্যে ক্ষান্তি দিয়েছেন।
এদিকে দেশটিতে হালচাষের জন্য ট্রাক্টর বিক্রি বেড়েছে। এতে চাষাবাদের জন্য গরুর বদলে যন্ত্রের কদর বেশি হয়েছে। কাজেই হালচাষের গরু এখন কৃষকদের জন্য বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কৃষকরা বলেন, তারা গরুকে অবশ্যই পবিত্র মনে করেন ও শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু হঠাৎ গরু বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে।
তারা বলেন, সরকারের উচিত আরও বেশি গরু আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা, পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা যাতে অবাধে তাদের পশু বাণিজ্য চালিয়ে যাতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা।
বিজেপি মুখপাত্র গোপাল কৃষ্ণ আগারওয়াল বলেন, সরকার কেবল অনুমোদনহীন কসাইখানা ও গরু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চালিয়েছে। তারা ইতিমধ্যে ১৩ হাজার গো-আশ্রয়খানাও তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, কাজেই আমরা কোনো সম্প্রদায় কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতিতে আঘাত হানতে চাই না।