বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে পদ্মাসেতুসহ অন্যান্য মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ানোর পুরনো ধারা শুরু হয়েছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের গতি। এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও অকারণ ব্যয় বৃদ্ধিরও সংস্কৃতিও তৈরি হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
তাই প্রকল্প গ্রহণের আগেই জমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটির বিষয়গুলো সমাধান করে বাস্তবায়নের সঠিক মেয়াদ ও ব্যয় নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে যোগাযোগ অবকাঠামোগত খাতে ২৬ হাজার ৩২৯ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা গত বছরের চেয়ে ৭ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বেশি।
এছাড়া পদ্মাসেতুর জন্য আগের বরাদ্দের চেয়ে ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছে সেতু বিভাগ। একই সঙ্গে প্রকল্পের সময় আরো দুই বছর বাড়ানোরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ হিসাবে প্রকল্পটির মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
এর সধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৭ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এবং প্রকল্পের সহায়তা থেকে ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
যদিও এর আগে ২০০৭ সালে একনেক সভায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মাসেতু নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্তে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।
এরপর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব ( ডিপিপি) সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ আবারও ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় হলো।
প্রস্তাব অনুসারে, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু নতুন প্রস্তাবে বাস্তবায়নকাল ২০২০ সালের জুন মাসে নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সেতু বিভাগের সূত্র জানায়।
এ ধরনের আরো কয়েকটি মেগাপ্রকল্পে একই প্রক্রিয়া চলছে। একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণে বিষয়টি পরিষ্কার হবে:
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসগক চার লেন
এটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক। কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজা থেকে চট্টগ্রামের সিটিগেট পর্যন্ত ১৯২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজে চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ৭ প্যাকেজের কাজের মাত্র ২২ শতাংশ বাকি ৩ প্যাকেজের কাজ হয়েছে ৪৩ শতাংশ।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে গত সোয়া চার বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের সময় ও নির্মাণ ব্যয়।
প্রাথমিকভাবে ২০১০ সালে শুরু হয়ে ২০১২ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় কাজের অগ্রগতি কম থাকায় তা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও শেষ করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদাররা।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় দুই দফা বৃদ্ধির পর ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ তৃতীয়বার ৭৮০ কোটি ১২ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ১৯০ কোটি ২৯ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এর আগে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০১০ সালের ২৭ জারুয়ারি ব্যয় বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৮২ কোটি ১৭ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যেখানে ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রকল্প অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ প্রকল্পে তিন দফায় প্রায় ১ হাজার ২২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে বলে সওজ সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন
উত্তরাঞ্চলের জেলাসহ ময়মনসিংহ জেলার সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে গাজীপুরের জয়দেবপুরের চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ মোড় পর্যন্ত ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটার দুই লেন সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে।
২০১০ সালে জুলাইতে কাজ শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার ছিল। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি কম এবং দুই প্যাকেজের মামলার কারণে কাজ বন্ধ থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তাও ব্যর্থ হতে চলেছে। তাই ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রস্তাব করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয় ৯০২ কোটি টাকা। পরে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব ( ডিপিপি) সংশোধন করে ২০১১ সালে ব্যয় ধরা হয় ৯৯২ কোটি ১০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় দফায় গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রকল্প ব্যয় ৮২৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৮১৫ কোটি ১২ লাখ নির্ধারণ করা হয়।
অর্থাৎ গত বছর সাড়ে চার বছরে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৯১৩ কোটি টাকা বা ১০১ শতাংশ। বাস্তবাযন বিলম্বে এ ব্যয়ও আরও বাড়বে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
ফ্লাইওভার
৮ দশমিক ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) ও ১৯৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ওডেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের ( ওএফআইডি) কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। অবশিষ্ট ২০০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে।
পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প ( পিপিপি) ভিত্তিতে চার লেনবিশিষ্ট মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারটির দুই বছরের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করার কথা। কিন্তু নকশা সংশোধনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারটি নির্মাণে ৬৬৮ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০০৫ সালে। পরে তা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা করা হয়। ২০১২ সালে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আরও ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা করার দাবি করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ( ডিএসসিসি) তা অনুমোদন না করায় আরবিট্রেশন মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে বলে ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘সরকারের নিজস্ব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতা পাবলিক পার্টারশিপ প্রজেক্টের ( পিপিপি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বাধা হয়ে থাকে। সরকারের ১০০ শতাংশ মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই সময় বেড়ে যায়। তাই বাড়ানো হয় প্রকল্পের ব্যয়। গত চার বছরে পিপিপি বাস্তবায়নে বাজেট ধরা হয় ঠিকই কিন্তু এই বাস্তবতার কারণে তেমন অগ্রগতি হয় না।’
তবে এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভালো কিছু পেতে হলে অপেক্ষা করতেই হবে। আর বড় বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে বিভিন্ন দাতাসংস্থার আর্থিক সহায়তায়। এখানে অনিয়ম বা দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই।’