শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝুঁকি নিত না

মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝুঁকি নিত না

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ চলমান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে মুজিব বাহিনী যতটা আগ্রহী ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী বা তৎপর ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের করণীয় বা ভূমিকা নিয়ে। তাদের হাবভাবে মনে হতো যে স্বাধীনতার পর দেশে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারের নিরাপত্তা দেওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য, যাতে বামপন্থীরা নতুন সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে না পারে। সে জন্য বাহিনীটি যাতে সংগঠিত থাকে এবং যুদ্ধোত্তর নতুন সরকারের পক্ষে কাজ করতে পারে সেই দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাই তারা মু্ক্িতযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ঝুঁকি নিত না। তা ছাড়া এদের ধারণা ছিল বা তাদের বলা হয়েছিল যে ভারত একদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেবে। তখন এরা স্বাধীন দেশের মূল সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে পুষ্ট অপর একটি বাহিনী গঠন করবে। সেই বাহিনীকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য একটি রাজনৈতিক পট তৈরি করার পরিকল্পনাও তাদের ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীর উত্তম তার সদ্য প্রকাশিত ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ গ্রন্থে এ কথা লিখেছেন।দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রথমা প্রকাশন থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

ভারতের দেরাদুনে এস এস উবানের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ

এ কে খন্দকার লিখেছেন:

মুজিব বাহিনীর প্রধান নেতারা শুরু থেকেই অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের বিরোধী ছিলেন এবং তাদের কার্যকলাপ যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। মুজিব বাহিনী বলত, অস্থায়ী সরকার অবৈধ, বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন না নিয়েই এটা গঠন করা হয়েছে এবং অবিলম্বে তা ভেঙে দেওয়া উচিত। এই মর্মে তারা রাজনৈতিক প্রচারণাও শুরু করে। এতে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা সন্তুষ্ট ছিল না। মুজিব বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ড আমার কানেও আসত। যুদ্ধের সময় যেখানে আমরা দেশকে স্বাধীন করতে এসেছি, সেখানে আমাদের নিজেদের মধ্যে এই রকম সম্পর্ক মোটেই কাম্য ছিল না। জেনারেল উবান জানতেন যে মুজিব বাহিনীর মূল নেতারা অস্থায়ী সরকারকে স্বীকার করে না এবং তাদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথাও বলে না। মুজিব বাহিনীর নেতারা তাজউদ্দীন সাহেবকে কমিউনিস্টদের প্রতিনিধি মনে করতেন। তারা জেনারেল উবানকে বলতেন যে ডি পি ধরের ইন্ধনে তাজউদ্দীন সাহেব আওয়ামী লীগ ছাড়াও কমিউনিস্টদেরও মুক্তিবাহিনীতে গ্রহণ করেছেন। মেজর জেনারেল উবান নিজেও তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে অস্থায়ী সরকারের নেতৃবৃন্দ, কর্নেল ওসমানী এবং মাঠপর্যায়ের সেনা কর্মকর্তারা মুজিব বাহিনীর গঠনকে মেনে নেয়নি। তিনি লিখেছেন:

বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার মানেই মূলত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেই বোঝাত, যিনি মুজিব বাহিনীর নেতাদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন না এবং তাদের সকল অভিযোগ তুচ্ছভাবে দেখতেন।

ফ্যান্টমস অব চিটাগাং : দ্য ‘ফিফথ আর্মি’ ইন বাংলাদেশ
মেজর জেনারেল এস এস উবান (অব.)
এলাইড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত), পৃ. ৩১

আমার সঙ্গে প্রথম যে দুজন মুজিব বাহিনী সদস্যের সাক্ষাৎ হয়, তারা নিজেদের পরিচয় দেন খসরু ও মন্টু নামে। এদের কাউকে আমি চিনতাম না, তারা নিজেরাই নিজেদের মুজিব বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেন। তারা বলেন যে তাদের কাছে অস্ত্র আছে, তারা তা বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে চান। তারা জানতে চান যে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীকে বিষয়টি জানাবেন কি না। এক পর্যায়ে আমি তারা কোথা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন জানতে চাই। তারা দুজন বেশ অন্যরকম একটা হাসি দিয়ে আমাকে জানান যে তারা ভারতের ভেতর থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। আমি আবারও জিজ্ঞেস করি, কোন স্থানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন? উত্তর প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে তারা বলেন যে সেটা জানাতে অসুবিধা আছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি যে তারা আমাদের সেক্টরের অধীনে থাকবেন কি না। তারা হেসে এর কোনো জবাব দেননি। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমার একটু খারাপ লাগল এই ভেবে যে আমি মুক্তিযুদ্ধের অভিযানগুলো সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আর মুজিব বাহিনীকে কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আর কোথায় কীভাবে তারা অভিযান পরিচালনা করবে, সেটা আমার কাছেও গোপন রাখা হয়েছে। পরে বিষয়টি আমি কর্নেল ওসমানীকেও বলেছি।

এর কিছুদিন পর বিভিন্ন সেক্টর অধিনায়কের কাছ থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করে যে তাদের সেক্টরে কিছু সশস্ত্র তরুণ নেতা এসেছে, যারা নিজেদের মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে এবং তারা সেক্টরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের নিজেদের দলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা প্রচার করছে যে সেক্টর অধিনায়কেরা কেউ না, তারাই সব। সেক্টর এলাকায় মুজিব বাহিনী সদস্যদের বিতর্কিত কার্যক্রম নিয়ে তাদের সঙ্গে সেক্টর অধিনায়কদের সংঘাত বা বিরোধ সৃষ্টি হয়। এসব বিরোধ ও দ্বন্দ্ব মাঝেমধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষের রূপ নেয়। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে সেক্টর অধিনায়ক ছাড়াও সাব-সেক্টর অধিনায়ক, এমনকি সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেও অভিযোগ আসতে শুরু করে। দুই বাহিনীর মধ্যে বিভেদের কারণে আমাদের সেক্টর অধিনায়ক ও অন্যদের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম নেয় তা ছিল যুদ্ধের শেষ অবধি। তারা অভিযোগ করত যে মুজিব বাহিনীর অনেক সদস্যই তাদের (মুজিব বাহিনীর) হয়ে কাজ করার জন্য সেক্টরের গেরিলাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করত। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা জোর করে সেক্টরের গেরিলাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কোনো কোনো জায়গায় তারা সফলও হয়। মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ পাওয়া যায় যে আমাদের গেরিলাযোদ্ধাদের যে লক্ষ্যবস্তুতে পাঠানো হতো মুজিব বাহিনীর সদস্যরা সেই লক্ষ্য থেকে তাদের বিচ্যুত করে অন্য লক্ষ্যে নিয়ে যেত। মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এ ধরনের বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে উভয় বাহিনীর মধ্যে কোথাও কোথাও গোলাগুলিও হয়েছে। এ ধরনের মারামারি, দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধে বিভাজনের সৃষ্টি করে। সেই সময় মুজিব বাহিনী প্রচার চালাচ্ছিল যে তারাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মনোনীত আসল মুক্তিযোদ্ধা। তাজউদ্দীন আহমদ চক্রান্ত করে ক্ষমতা দখল করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে যাতে দেশদ্রোহের অভিযোগে পাকিস্তানিরা মৃত্যুদণ্ড দেয়, সেই জন্যই তাজউদ্দীন সরকার গঠনের ব্যবস্থা করেছেন।

সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের এসব নালিশের বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম। এরকম প্রথম নালিশ আসে আগস্ট মাসের দিকে। এ সময় মুজিব বাহিনী নিয়ে নানা মহল থেকে আরও জোরেশোরে কথা উঠতে শুরু করে। সেক্টর অধিনায়কেরা এদের সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রশ্ন করে। তারা অভিযোগ করে যে এমন অবস্থা চললে যুদ্ধ চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে। কর্নেল ওসমানীর কাছে বিভিন্ন সেক্টর থেকে এমন অভিযোগ একের পর এক আসতে থাকে। জাতির একটি ক্রান্তিকালে তাদের এই ধরনের আচরণ দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। সব অভিযোগই যে লিখিত আকারে আসত তা নয়, মৌখিকভাবেও জানানো হতো। ওই সময় আমাদের সব রকমের দাপ্তরিক সুবিধা ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং সেই কাঠামো সচল রাখার জন্য যে লোকবল ও অন্যান্য সহযোগিতার প্রয়োজন, সব ক্ষেত্রে তা পাওয়াও সম্ভব ছিল না। তাই এ ধরনের সব ঘটনা যে সেক্টর এলাকা, সীমান্ত, এমনকি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে ঘটেছিল, তার বিবরণ আমাদের কাছে পৌঁছাত না। এর অংশবিশেষ আমরা বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ে পরে জানতে পারি। পাঠকের অবগতির জন্য বইয়ের শেষে পরিশিষ্ট ৩ ও ৪-এ এ ধরনের ঘটনা নিযে দুটি চিঠি যুক্ত করা হলো।

এই সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল ওসমানী এই বাহিনীর ওপর ক্রমশ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের গোচরীভূত করেন এবং মন্ত্রিপরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করেন। মন্ত্রিপরিষদ সভাতেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় এবং সে আলোচনা ছিল বেশ উত্তপ্ত। মন্ত্রিসভার সব সদস্য এ বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও দায়িত্ব নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। আমি যতটুকু জানি, এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে ভারতীয় সরকারকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই বাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও মন্ত্রিসভা ভারত সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চায়। প্রশ্ন করা হয় যে বাংলাদেশ সরকারকে না জানিয়ে কেনই বা এমন একটা বাহিনী গড়ে তোলা হলো। মন্ত্রিসভায় যদিও আলোচনা হয়েছিল যে মুজিব বাহিনীর বাংলাদেশ সরকারের আওতায় এবং কেন্দ্রীয় ও একক নেতৃত্বের অধীনে থাকা উচিত, কিন্তু আমার মনে হয়নি মন্ত্রিসভার সব সদস্য এ বিষয়ে অন্তরে একমত পোষণ করেছেন। আমার মনে হয়েছিল যে তাদের মধ্যে কোথায় যেন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। আমার এ কথাও মনে হয়েছিল যে মন্ত্রিসভার কেউ কেউ মুজিব বাহিনীর বিষয়ে আগে থেকেই জানতেন। এ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু সে সময় তাদের কথাবার্তায় এমনই মনে হয়েছিল।

কর্নেল ওসমানী বলেছিলেন, মুজিব বাহিনীর এই সব কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বারবার প্রশ্ন করেছিলেন যে সমস্ত বাহিনী, অর্থাৎ নিয়মিত বাহিনীসহ গেরিলাসহ গেরিলা ও মুজিব বাহিনী কেন কেন্দ্রীয় সামরিক নেতৃত্বের আওতায় বা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না? তিনি চেয়েছিলেন, সব বাহিনী বাংলাদেশ বাহিনীর একক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মন্ত্রিসভায় বিষয়টি আলোচনার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, যেখানে উল্লেখ ছিল যে সব গেরিলাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী বাংলাদেশ বাহিনীর অধীন থাকবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এর কোনো প্রভাব যুদ্ধক্ষেত্রে পড়েনি এবং সত্যিকারভাবে মুজিব বাহিনী কখনোই বাংলাদেশ বাহিনীর অধীনে আসেনি।

সেক্টর অধিনায়ক এবং অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া তথ্য দেখে মনে হয়েছে মুজিব বাহিনী চলমান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে যতটা না আগ্রহী, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী বা তৎপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের করণীয় বা ভূমিকা নিয়ে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে তাদের যে একটা সামরিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা থাকবে, সে বিষয়টি আমার কাছে বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই লক্ষ্য বা ভূমিকা সম্পর্কে তখন স্পষ্ট করে কিছু জানতে পারিনি। আমার ধারণা, মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরাই শুধু জানতেন, নিচের দিকের সদস্যরা এই বাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানত না।

মুজিব বাহিনী সম্পর্কে ভারত সরকারের মনোভাব অনেকটা ধোয়াটে ছিল। তাদের মনোভাব আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারিনি। মুজিব বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও এদের কারণে সৃষ্টি অসুবিধা সম্পর্কে ভারত সরকারকে অবহিত করা হলেও তারা এমন কিছু করেনি যাতে এই বিশেষ বাহিনীর কর্মকাণ্ড হ্রাস পায় বা যাতে এ বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আসে। যুদ্ধের ময়দানে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর দ্বন্দ্বের সংবাদে তাজউদ্দীন সাহেব সতর্ক হন। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে কথা বলার জন্য তিনি দিল্লিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাজউদ্দীন সাহেব তাকে বলেন যে মুক্তিযুদ্ধে একটি বাহিনী হবে। যদি দুটি বাহিনী থাকে এবং তাদের যদি দুটি উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে যুদ্ধ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে মুজিব বাহিনীর কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য দৃঢ়ভাবে অনুরোধ করেন।

আমার ধারণা, মুজিব বাহিনী গঠন বিষয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন এবং নিশ্চিতভাবেই তার সম্মতিতেই বাহিনীটি গঠিত হয়েছে। তার মতামতের বাইরে এই বাহিনী গঠন অসম্ভব ছিল। মুজিব বাহিনীর প্রধান জেনারেল উবান তো ভারত সরকারের বাইরের কেউ ছিলেন না। আমি শুনেছি, শ্রীমতী গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবকে জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি দেখবেন। আমি যত দূর জানতে পেরেছি, আশ্বাস দেওয়া ছাড়া ভারত সরকার এ বিষয়ে তেমন কিছু আর করেনি। আমার মনে হয়েছে, তারাও চেয়েছে যে মুজিব বাহিনী সক্রিয় থাকুক এবং তাদের ওপর ন্যস্ত কাজ চালিয়ে যাক। আমার আরও মনে হয়েছে, সেই সময় ভারতে যে নকশাল আন্দোলন চলছিল তা ক্রমশ বেশ জোরদার হয়ে উঠছিল। ফলে গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ যদি বামপন্থী হয়ে যায় বা নকশাল আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে ভারত সরকার মুজিব বাহিনীকে নকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবে। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও যদি বামপন্থীদের হাতে চলে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায়, তাহলে এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হবে। যে কারণে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি, যাতে মুজিব বাহিনীকে দিয়ে সৃষ্ট সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধানে আসা যায়। আরও একটি কারণ মুজিব বাহিনী গঠনে ভারত সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে, তা হচ্ছে তাজউদ্দীন আহমদের ওপর ভারতীয়দের একটি সার্বক্ষণিক চাপ বজায় রাখা। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব পুরোপুরিভাবে তাজউদ্দীন-বিরোধী ছিল। তারা কখনোই তাজউদ্দীন সাহেবকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাই ভারতীয়রা মুজিব বাহিনীকে তাজউদ্দীন সাহেবের বিকল্প বা সমান্তরাল হিসেবে সৃষ্টি করে থাকতে পারে। আসলে মুজিব বাহিনী বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ বাহিনীর আওতায় আসুক, এটা কৌশলগত কারণেই ভারত সরকার চায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থক ছাড়া আর কাউকে যুদ্ধে নেওয়া হবে না। এই প্রতিবন্ধকতার জন্য ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা প্রাথমিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আগস্ট মাসে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর ডি পি ধর আমার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ-কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর পর মুক্তিবাহিনীতে তাদের নেওয়া শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির কিছু নেতা-কর্মী প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়, কিন্তু তাদের কোনো একক কমান্ড ছিল না। এতে তাদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি হয়। তখন আমি নিজে একটা পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করি যাতে মুজিব বাহিনী, ছাত্র ইউনিয়ন এবং অন্য গেরিলারা ঐক্যবদ্ধভাবে অপারেশন করতে পারে। এর জন্য আমি মুজিব বাহিনীর তোফায়েল আহমেদ এবং ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলামের সঙ্গে কয়েকটা বৈঠক করেছি। তোফায়েল আহমেদ মুখে মুখে সম্মতি জানালেও কার্যক্ষেত্রে তার এই উত্তরের প্রতিফলন খুব একটা দেখতাম না। তবে নুরুল ইসলামের উৎসাহ ছিল। আমি কয়েকটা বৈঠক করার পর উপলব্ধি করি যে এখানে জোর খাটিয়ে কিছু করবার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত আমার চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। অক্টোবরের দিকে ডি পি ধর মুজিব বাহিনী এবং অন্য সব গেরিলার মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন। জেনারেল বি এন সরকারও এ বিষয়ে চেষ্টা করেন, কিন্তু তার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মুজিব বাহিনী পৃথকভাবেই তৎপর ছিল।

ভারত সরকারের জ্ঞাতসারে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে আসার আগেই তারা (মুজিব বাহিনী) ভারতে ঢোকে এবং প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। তা না হলে ভারতে এসে তাদের যে অবস্থায় দেখেছি, সেই অবস্থায় থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ থেকে বোঝা যায়, মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব বেশ আগেই ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পন্ন করেছিল এবং হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই তারা সীমান্ত পেরিয়ে পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তির কাছে বা স্থানে পৌঁছে যায়। ভারতও তাদের জন্য দ্রুত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্রের বন্দোবস্ত করে। মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব কর্মকাণ্ড করেছিল তা মুক্তিযুদ্ধকে কোনো গরিমা এনে দেয়নি বরং কলুষিত করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই মুজিব বাহিনীর কিছু সদস্য লুটপাটে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে সহযোগিতা করাতো দূরের কথা বরং তাদের কর্মকাণ্ড সরকারকে ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। মুজিব বাহিনী সৃষ্টির যে মূল লক্ষ্য ছিল, অর্থাৎ নতুন সরকারকে শক্তিশালী করা, তা মাঠে মারা যায়। তারা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যের রূপ নেয়। কিছুদিন পর তো তারা সরাসরি অবস্থান নেয় সরকার তথা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই। সংবাদ২৪.নেট ডেস্ক