শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > আন্তর্জাতিক > মিশরে গণহত্যা

মিশরে গণহত্যা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ মিশরে এসব কি হচ্ছে? নিহতদের বলা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসী’। ইসরাইল শত্রুদের এ নামেই ডেকে থাকে। মার্কিনিরাও তাই। মিশরীয় এক বন্ধুর সঙ্গে সাাৎ হলো আমার। তিনি বললেন, দেশের পতাকার দিকে তাকিয়ে তিনি শুধুই কেঁদেছেন। মিশরের মিডিয়া একে অভিহিত করেছে সংঘাত হিসেবে। যেন সশস্ত্র মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্য সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। কেন এত মৃত্যু? কে তাদের হত্যা করছে। মিশরে অনেক মুরসী বিরোধী লোক আছেন যারা আমাকে বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন না ব্রাদারহুডের সদস্যরা অস্ত্র হাতে সংঘাতে লিপ্ত। যদিও এক ব্রাদারহুড সদস্যকে আমি মেশিনগান হাতে দেখেছি। কিন্তু সত্য হলো- এটা যে, পুলিশ নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি করেছে এবং একজন পুলিশও মারা যায়নি। এটা নির্জলা গণহত্যা। এ ঘটনার জন্য অন্য কোন শব্দ প্রযোজ্য নয় এবং আমাদের প্রিয় (বৃটেনের) মন্ত্রী কি বলছেন? তিনি মিশরীয় কর্তৃপকে বলছেন, তারা যেন সংঘাত বন্ধ করে। কারণ এখন সংঘাতের সময় নয়, এখন সংলাপের সময়। তিনি সিরিয়ার েেত্র এমনটি বলেন না। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কি দামেস্কের রাজপথে কি এতগুলো মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছেন? আমাদের এ ভীতির কথা জাতিসংঘেরও প্রতিধ্বনি তোলা উচিত। কিন্তু এটা দামেস্ক নয়। এটা কায়রো। তাই আমরা জেনারেলদের প্রতি নয় আমাদের বন্ধুদের প্রজ্ঞা জাগাতে বলছি। ল্য করুন, মিশরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাবা মসজিদের বাইরে অবস্থানরত মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের হুমকি দিয়েছেন। বলেছেন- তাদের অবস্থান তুলে দেয়ার জন্য আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন। আমরা আশা করবো তাদের চেতনা ফিরবে। তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। তারা যখন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে তখন কি তারা তা করেনি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেছেন, মুসলিম ব্রাদারহুডের মাত্র ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে আমি কেন হাসপাতালের মেঝেতে ৩৭টি মৃতদেহ দেখতে পেলাম?
মিশরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই বা কি? আপনি নির্বাচনে অংশ নিলেন এবং বিজয়ী হলেন। তারপর একজন জেনারেল (জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি) আপনাকে উৎখাত করলেন। তাহলে মিশরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি? পশ্চিমারা মিশরকে ভালবাসতে পারে। কিন্তু এ দেশটি এখন পরিচালিত হচ্ছে কঠোর একজন জেনারেলের হাতে, আমরা কি ভাবি তার প্রতি তিনি তোয়াক্কাও করেন না। তিনি মনে করেন, মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানের চেয়ে ইসরাইলের সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা, পশ্চিমারা তাদের এই ধারার সঙ্গে এগিয়ে চলেছি। ওবামা মিশরীয়দের বলেছেন, মিশরীয়রা ভবিষ্যতে যে পথ নির্মাণ করবে তার শক্তিশালী অংশীদার হবে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে মিশরীয়রা দেশকে পিছন দিকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছে। বিপ্লব পরবর্তী মতা পরিবর্তনে তাই সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। ভুলে যান হাসপাতালে আমি যে ৩৭টি মৃতদেহ দেখেছি তার কথা। ভুলে যান প্রেসিডেন্ট ওবামা কায়রো ইউনিভার্সিটিতে যে বক্তব্য রেখেছিলেন চার বছর আগে তার কথা। আমরা এখন বিপ্লব পরবর্তী অবস্থার মধ্যে রয়েছি।
গণহত্যার চিত্রটিই বা কেমন? কাফনে মোড়ানো একটি লাশ। কাফনের গায়ে কালো কালিতে লেখা নাম খালেদ আবদুল নাসের। ওই ঘরেই ছিল ৩৭টি লাশ। পুরো ঘরটিতেই রক্তের ছোপ। চিকিৎসকদের পোশাকেও রক্তের দাগ। রাবা মসজিদের পাশের হাসপাতালে কান্নারত নারী-পুরুষের ভিড়। অনেকেই আল্লাহকে ডাকছিলেন। একজন চিকিৎসক আমাকে বললেন, এই মানুষগুলো এখন আল্লাহর সঙ্গে আছে আর আমরা আছি ছায়ার সঙ্গে। সবাই মনে হলো নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী। আর মৃত ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই গুলি লেগেছে মুখে-বুকে। চরম দুর্দিনে মানুষ যেসব কথা বলে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরাও তাই বলছেন। তারা বলছেন, সামরিক শাসনের অধীন হওয়ার বদলে তারা মৃত্যুকেই বেছে নেবেন। আর এসব কথা বলা হচ্ছিল সেই দেশে যে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানকে সামরিক অভ্যুত্থান বলা যাচ্ছে না। ড. হাবিব বলছিলেন, মৃত্যুর পরেও জীবন রয়েছে। আমি তাকে বলেছিলাম, প্রমাণ দিতে। তিনি বললেন, আমরা পশু নই। সারাটা জীবন কেবল খাদ্য খাওয়া আর পানি পান করা আমাদের কাজ নয়। হাসপাতালে আমাদের মনোযোগ ছিল কেবল মৃত মানুষের দিকে। এত তাজা মৃত্যু যে, তাদের চেহারায় এখনও মৃত্যুর চিহ্ন পড়েনি। একজন চিকিৎসক একটি লাশের চোখ বন্ধ করতে পারছিলেন না। চোখ বন্ধ করতে আরেকজন চিকিৎসকের সাহায্য চাইলেন তিনি। এটাই হয়তো নিয়ম। মৃত্যুকে আমাদের ঘুমন্ত মানুষের মতো দেখতে হয়। মিশরও হয়তো সেরকম একটা অবস্থাতেই পড়েছে। যেখানে অনেক কিছু থেকেই অনেককে চোখ বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে।
আরেকটি লেখায় রবার্ট ফিস্ক লিখেছেন:
মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে লাখো মানুষ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। তারা অবস্থান নিয়েছেন রাজধানী কায়রোর রাবা মসজিদের বাইরে। অন্যদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির লাখো সমর্থক অবস্থান নিয়েছেন তাহরির স্কয়ারে।
এটা এক অপ্রত্যাশিত অদ্ভুত ঘটনা। আপনি যা খুশি সেভাবে বর্ণনা করতে পারেন এটাকে। কিন্তু তাহরির স্কয়ারে অবস্থানকারীদের মাথার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের অবস্থানের বিপরীতে দাঙ্গা পুলিশ ও সেনারা অবস্থান নিয়েছেন। এতে দু’টি বিােভের নিজস্ব চেহারা ফুটে উঠে। সবকিছুই যে খারাপ হচ্ছে সাংবাদিকদের এমনটা বলা ঠিক না। কিন্তু ২৬শে জুলাই রাতে কায়রোতে যা ঘটে গেছে তা মোটেও ভাল না।
দুঃখের বিষয় হলো, সবচেয়ে ট্রাজিক বিষয় হলো- মিশরে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে এখন থেকে প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে মতাচ্যুত করা হয়েছে। তার সমর্থকদের এখন বিরোধীরা ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছে। মুরসির সমর্থকরা অবস্থান নিয়েছেন নসর শহরে বিমানবন্দর সড়কে একটি মসজিদের বাইরে। তারাও তাহরির স্কয়ারের জনতার সমুদ্রের মতো সমানভাবে উৎফুল্ল। তাদের বিােভে অংশ নিতে যাওয়া লোকদের স্বাগত জানানো হচ্ছে। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপো করে হাজার হাজার মানুষ নীল নদের ব্রিজ পার হয়ে যোগ দিচ্ছে তাদের সঙ্গে।
কিন্তু তাদের সেই উৎসাহ, উন্মাদনা শেষ হয়ে গেছে। যে মসজিদের সামনে মুরসি সমর্থকরা অবস্থান নিয়েছে তার কাছেই সেনাবাহিনীর ব্যারাক। তাদের হাতে মোহাম্মদ মুরসির ছবি আঁকা বিশাল বিশাল ব্যানার, পোস্টার। কেউ বা সামরিক বাহিনীর ব্যারাকে এঁকে দিয়েছে স্টার অব ডেভিড-এর ছবি। কেউ যাতে ভিতরে প্রবেশ করে তাদের আক্রমণ করতে না পারে এ জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের সমাবেশের বাইরের রাস্তায় বালুভর্তি হাজার হাজার বস্তা ফেলে, ইটপাথরের স্তূপ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তা সেনাদের থামাতে পারে নি। এখানে বলে রাখা ভাল, সেনারা উল্লাস করতে করতে যুক্তরাষ্ট্রে ও ফ্রান্সে তৈরি সাঁজোয়া যানের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে এগিয়ে যায়। তাদের হাতে ছিল কাঠের লাঠিও। তাদের সঙ্গে ছিল কালো ইউনিফর্ম পরা বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখে দাড়ি আছে এমন অনেকে তখন রাস্তার পাশে বসে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। অনেকেই তা শুনছিলেন। এসব কিছুর কোন তোয়াক্কা করেনি সেনারা। তারা দু’এক ঘণ্টার মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের দিকে অভিযান শুরু করবে বলে মনে হচ্ছিল। তবে তার পরের কয়েক ঘণ্টা ভয়াবহ হয়ে উঠবে এমনটা কল্পনা করাও ছিল কঠিন।

(লন্ডনের দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত রবার্ট ফিস্কের লেখার অংশবিশেষের অনুবাদ)।