বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে আটকে গেছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর সম্মেলনের পরের দিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই নতুন কমিটি দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। তারা দুজনেই সভাপতির পদ প্রত্যাশী। তবে কামরুল ইসলাম বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, মায়া ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব কিছু হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি কী কারণে ঝুলে আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন। এ ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে সবকিছু জানতে পারবেন।’
জানা গেছে, ২০১২ সালের সম্মেলনে নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ সভাপতি পদ প্রত্যাশী। দলের প্রবীণ নেতা ও ওয়ান-ইলেভেনের পর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় সভাপতি থেকে তাকে বাদ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও সভাপতি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এক-এগারোর সময় দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও সভাপতির পদ প্রত্যাশী। এছাড়া সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার ও সংসদ সদস্য একেএম রহমতউল্লাহও এই পদে আসতে চান।
দলের সভাপতির সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সম্পর্ক ভালো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সভাপতির মুক্তির আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, কারাবরণ করেন। তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে চান। নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. সেলিমও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। তিনি এক সময় নগর আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন।
এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, ২০১২ সালের সম্মেলনে নগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা পদ চান। আবার অনেক ত্যাগী নেতাও পদ চেয়েছেন। ফলে কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে এই আশঙ্কাই দলীয় সভাপতি কমিটি ঘোষণা করছেন না।
জানা গেছে, গত ২০১২ সালের ২৮ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার দিন ধার্য থাকলেও তা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে এই পূর্ণাঙ্গ কমিটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর রয়েছে বলে ওই সূত্র দাবি করেছে।
আরেকটি সূত্র দাবি করেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর পূর্ণাঙ্গ কমিটির দায়িত্ব দেয়া থাকলেও এ সম্পর্কে কাজ করছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
এদিকে মহানগর কমিটি কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে তা জানেন না সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। ফেব্রুয়ারি থেকেই ঢাকা মহানগর ওয়ার্ড থানা কাউন্সিল শুরু হয়েছে এবং তা ওই মাসের মধ্যেই শেষ করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শহীদুল হক মিলন বলেন, ‘মায়া ভাইয়ের শিষ্য হলেন কামরুল ভাই। তাই তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কারণ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি ধরে রেখেছেন।’
অপর এক সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই ঘোষণা করা হচ্ছে না ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি। মহানগরীর সব ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা সম্মেলন শেষ হলেও মূল কমিটি নিয়ে চলছে দর কষাকষি। আর এ সময় পর্যন্ত বহাল থাকছে বর্তমান কমিটিই।
অন্যদিকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলীয় হাইকমান্ড নগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণার আগে সব ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা কমিটির সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে গুছিয়ে নেয়ার পক্ষপাতী। তবে নগর আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড সম্মেলন শেষের পথে থাকলেও মূল কমিটি কবে নাগাদ ঘোষণা হবে এমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় হতাশায় ভুগছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা।
জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসন করে দলকে শক্তিশালী করাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে দলীয় নীতিনির্ধারক মহল। এ কারণেই এই মুহূর্তে নগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা না করে নগরীর সব ইউনিটের সম্মেলন শেষ করার পক্ষেই মত দেয়া হয়েছে। নগরীর অন্তর্ভুক্ত ১০০টি ওয়ার্ড, ৪৯টি থানা ও ১৯টি ইউনিয়নে দলীয় সম্মেলন শেষ করার সময় ফেব্রুয়ারি মাস সময় দেয়া হয়। ফলে মার্চে নগর কমিটি গঠন ও ঘোষণার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
সূত্রমতে, ইতিমধ্যে দলীয় হাইকমান্ড নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রমের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি ইউনিট সম্মেলন করবে। হাইকমান্ড আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব ইউনিট সম্মেলন শেষ করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।
এই নির্দেশকে কেন্দ্র করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘এই সময়ের মধ্যে থানা ও ওয়ার্ডের সম্মেলন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কমিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভেঙে যাবে।’
এ কারণেই ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে সদস্য নবায়ন ও সংগ্রহের বই পাঠানো হয়েছে। এ অনুযায়ী সদস্য সংগ্রহ অভিযানও শুরু হয়েছে জোরেশোরে।
জানতে চাইলে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বাংলামেইলকে জানান, কিছু বিষয় ঠিক করেই নগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হবে। এ কারণে কমিটি ঘোষণায় দেরি হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলামের দ্বন্দ্বের কারণে কমিটি হচ্ছে না বিষয়টি এমন নয়।’
নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ জানিয়েছেন, কেন্দ্র থেকে নগরের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা সম্মেলন শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইউনিট সম্মেলনগুলো করা হচ্ছে।
কবে নাগাদ মহানগরের মূল কমিটি দেয়া হতে পারে এ সম্পর্কে আজিজ বলেন, ‘মূল কমিটির দায়িত্ব দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর রয়েছে। এর সঙ্গে আরো রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। তাই কেন্দ্রীয় নেতারা যেদিন কমিটি দেবেন সেদিনই হবে।’
মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি ও সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও কর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। নগর আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করার জন্য নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন। নতুন কমিটি ও নেতৃত্ব না পেয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে যাচ্ছেন, যা নগর আওয়ামী লীগে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নেতারা আরও জানান, কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলেও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। এতে নগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি একাধিকবার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার শুধু আশ্বাসই দিয়ে গেলেও ঘোষণা করা হচ্ছে না।
এদিকে গত ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক কাযনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে সম্মেলন শেষ করে নগরের জন্য নতুন কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এই সিদ্ধান্তকে নগর নেতাকর্মীরা শুধু আশ্বাস হিসেবেই দেখছেন বলেও অনেকে জানিয়েছেন।
ওয়ার্ড নেতারা অভিযোগ করেছেন, মহানগরের মূল নেতারা কর্মীদের বাইরে রেখে নিজেদের মতো করে কেন্দ্রের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলেন। কর্মীদের কোনো খোঁজ রাখেন না। এমন কী তাদের কাছে গেলে পাত্তা দেয়া হয় না।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, ‘নগরের থানা ও ওয়ার্ডের কমিটিগুলো হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটিও হবে।’ একই সঙ্গে মহানগরের কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেও জানান তিনি। বাংলামেইল২৪ডটকম