আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে জনপ্রিয়তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি। পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রীই দলের সর্বেসর্বা। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। গত জানুয়ারিতে ১৯ বছরে পা দিয়েছে তৃণমূল। এত দিন পর প্রশ্ন উঠেছে, তিল তিল করে গড়া তৃণমূল কী ভেঙে যেতে বসেছে?
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে মাত্র একটি আসনে জিতলেও হাল ছাড়েননি মমতা। দলকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে শরিক হওয়ার খেসারত হিসেবে মাত্র একটি আসনে জিতেছিলেন তিনি। সেটি ছিল তাঁর নিজের আসন। বিজেপির সঙ্গে গাঁট বাঁধাটা সুনজরে নেননি এই রাজ্যের সংখ্যালঘুরা। রাজ্যের ২৮ শতাংশ সংখ্যালঘু শ্রেণির মানুষের দেওয়া জবাব থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলেন মমতা। এরপর বিজেপি জোট ছেড়ে লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে জিতে নেন ৩৪টি আসন। এরপর তাঁর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পালা। এর আগে ২০১১ ও ২০১৬ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে তুলোধুনা করে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসেন তিনি। তৃণমূলের জন্ম থেকে মমতার ছায়াসঙ্গী ছিলেন মুকুল রায়। মুকুল রায়কে বলা হতো তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর তৃণমূল ছাড়েন মুকুল রায়। তবে রাজ্যসভার সদস্যপদ ছাড়েননি তিনি। ঘোষণা দিয়েছিলেন, পূজার পরই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্যসভার সদস্যপদ ছাড়বেন। আগামী ৮ অক্টোবর দিল্লি যাবেন মুকুল রায়। পরদিন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ও ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ভেংকাইয়া নাইডুর সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। কেন তিনি তৃণমূল ছাড়লেন বা তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মসূচি কী, তা দিল্লিতেই সাংবাদিক সম্মেলনে জানানোর কথা রয়েছে তাঁর।
গত রোববার মুকুল রায় জানান, অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন কি না বা নতুন দল গড়বেন কি না, তা ওই সংবাদ সম্মেলনেই জানাবেন তিনি।
মুকুল রায়ের পদত্যাগকে ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন? কারণ, মুকুল রায়ের সঙ্গে মমতার দ্বন্দ্ব¦তীব্র হওয়ার পর মুকুল রায় বিজেপির নেতাদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অভিযোগ, তিনি বিজেপির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখেছিলেন। এ ছাড়া মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে সারদা ও নারদ ঘুষ কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতি মামলারও অভিযোগ রয়েছে। এ মামলার তদন্তের দায়িত্বে আছে সরকারের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই এবং ইডি। তাই এসব মামলা থেকে রেহাই পেতে তাঁর বিজেপিতে যোগদান ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতারা। আর বিজেপিতে গেলে মমতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতেও পারবেন তিনি। এ ছাড়া নতুন একটি দল গড়ার কথা ভেবেছিলেন মুকুল। এতে যে ফল ভালো হবে না, তা অনুধাবন করে সে উদ্যোগ থেকে তিনি সরে এসেছেন বলে মনে করছেন রাজনীতিকেরা।
প্রশ্ন উঠছে, মুকুল রায়ের বিদায়ে তৃণমূল কি ভাঙতে চলেছে? রাজনীতিকদের একাংশ মনে করে, মুকুল একজন দক্ষ সংগঠক—এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তৃণমূল ছাড়লে তাঁর ভক্তদের একাংশ তাঁর সঙ্গেই থাকবেন, এটাও নিশ্চিত। এ ছাড়া তৃণমূলের ছয় বছরের শাসনে অনেক নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক ও সাংসদ মমতার বিরাগভাজন হয়েছেন। তৃণমূলে এমন নেতাও আছেন, যাঁরা মমতার সংখ্যালঘুদের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা মেনে নিতে পারছেন না। এ কারণে ওই নেতারা বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন। আবার একটা অংশ মনে করছে, মুকুল চলে গেলেও দলে কোনো প্রভাব পড়বে না। মমতা এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী, তাই দল ভাঙারও প্রশ্ন ওঠে না। যদিও এই যুক্তি পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না তৃণমূলের অনেকেই।
সারদা, নারদ ও রোজভ্যালি আর্থিক কেলেঙ্কারি—এই তিনটি দুর্নীতি মামলা মমতার সততার মুখে কালি মেখে দিয়েছে। এসব মামলায় জড়িয়ে পড়েছে তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কেরা। রাজ্যের সাধারণ মানুষও উপলব্ধি করা শুরু করেছেন, মমতা ভালো হলেও তাঁর দলে রয়েছে দুর্নীতির বাসা। তা না হলে এই তিন মামলায় তৃণমূলের নেতারাই জড়াচ্ছেন! তাই মুকুল রায় ও তাঁর সমর্থকেরা তৃণমূল ছাড়লে দল যে একটা বড় ধাক্কা খাবে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মমতা। এ কারণে কারা মুকুল রায়ের পেছনে এবং তৃণমূলের কোন কোন নেতাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখছেন, তা জানতে দল ও গোয়েন্দা নিয়োগ করেছেন মমতা। এর উদ্দেশ্য হলো মুকুল রায়ের নজর থেকে এসব নেতার নজর তৃণমূলের দিকে ফেরাতে হবে।
কলকাতার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, মুকুল রায় রাজ্যসভার সদস্যপদ (সাংসদ) থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর তিনি বিজেপির গেরুয়া পোশাক পরবেন। তৃণমূল থেকে চলে যাবেন বিজেপিতে। তাই ৯ অক্টোবর রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগের পর মুকুল রায় কী ঘোষণা দেন, তা শোনার জন্য রাজ্যবাসীও অধীর আগ্রহে আছেন।
মুকুল রায় তৃণমূলের টিকিটে ২০১২ সালে ৩ এপ্রিল রাজ্যসভার সদস্য হন। ওই বছরের ২০ মার্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। দলের সর্বভারতীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন তিনি। খুচরা ব্যবসায়ে বৈদেশিক বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে তৎকালীন মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে বিরোধ বাধলে মমতা ইউপিএ সরকার ছাড়েন। সে সময় রেলমন্ত্রীর পদ চলে যায় মুকুল রায়ের। মুকুল রায়ের আগে রেলমন্ত্রী ছিলেন তৃণমূলেরই দীনেশ দ্বিবেদী। তিনি রেল বাজেটে রেলভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দিলে খেপে যান মমতা। পরে দীনেশকে সরিয়ে মুকুলকে রেলমন্ত্রীর পদ দেন মমতা।
তবে সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি, নারদ ঘুষ কেলেঙ্কারিসহ দুর্নীতির মামলায় মুকুলের নাম আসায় চরম অস্বস্তিতে পড়েন মমতা। এ থেকেই তাঁর সঙ্গে মুকুল রায়ের দূরত্ব তৈরি হয়। সবশেষ মুকুল দল থেকে পদত্যাগ করেন।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলন করে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দলবিরোধী কাজ করার অভিযোগে সংবাদ সম্মেলনে মুকুল রায়কে ছয় বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন তিনি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ করে বলেন, পাড়ার মানুষ যাকে চিনতেন না, তাঁকেই রাজ্যসভার সদস্য ও রেলমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ তিনিই দলকে দুর্বল করার অঙ্ক কষেছিলেন। নিজের স্বার্থে দলকে ব্যবহার করেছেন। দলের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন। কেন্দ্রীয় সংস্থার চাপের কাছে নতিস্বীকার করে দলের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়েছেন। দল থেকে তিনি চলে যাওয়ায় দলের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, মানুষ মমতার সঙ্গেই আছে।
এদিকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সম্প্রতি বলেছিলেন, তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা বা বিধায়ক বিজেপিতে যোগদানের জন্য অপেক্ষায় আছেন। মুকুল রায়ের ইস্তফা কি তারই ইঙ্গিত বহন করছে—এ প্রশ্নটিই এখন রাজনৈতিক মহলে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।- প্রথমআলো অবলম্বনে