শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ভক্ষকই ‘রক্ষক’, বিনিময়ে কোটি টাকা

ভক্ষকই ‘রক্ষক’, বিনিময়ে কোটি টাকা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ অটোরিকশা প্রতি ২ হাজার টাকা করে দিতে হবে, না হলে চুরি হয়ে যাবে সেই সিএনজি অটোরিকশা! প্রকাশ্যেই এই দাবি করছে আন্তঃজেলা সিএনজি অটোরিকশা চোররা। আর তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ চক্র। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে তাদের আদিপত্য।

সিএনজি অটোরিকশা ‘চুরি প্রতিরোধের’ নামে এই টাকা আদায় করা হচ্ছে গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে। খোদ রাজধানীতেই বছরের পর বছর ধরে ঘটে চলেছে অদ্ভুত এই ‘জিম্মি চাঁদাবাজি’র ঘটনা। পান থেকে চুন কষলেই চোখের পলকেই হাওয়া হয়ে যায় কষ্টের টাকায় কেনা অটোরিকশাটি।

শ্যামপুরের পোস্তগোলায় কিলার মফিজ ও তার ভাই শামীমসহ একটি চক্র চোরদের দিয়ে এই ‘জিম্মি চাঁদাবাজি’ চালিয়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এভাবে তারা মাসে আদায় করছে কোটি টাকা। সিএনজি অটোরিকশা চোর সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান হচ্ছে বাবুল। এই চক্রের শীর্ষ পর্যায়ের অন্য যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন- লেংড়া মিলন, আক্তার, রহিম ও শাকিল। তাদের সবার গডফাদার কিলার মফিজ।

সরেজমিনে ঘটনাস্থল ঘুরে এবং সিএনজি মালিক-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিলার মফিজ নামে পরিচিত মফিজ এই চক্রের মূল হোতা। তার ছোটভাই শফিকুল ইসলাম শামীম ও সিএনজি চোর বাবুল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড। সংশ্লিষ্ট দু’টি থানা পুলিশ, স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এই চাঁদাবাজি। পুলিশ ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এই চক্রটির কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করেই চলছে সিএনজি মালিক ও চালকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা ব্রিজসহ আশপাশের তিনটি রুট দিয়ে মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পাঁচ হাজারেরও বেশি সিএনজি অটোরিকশা প্রতিদিন চলাচল করে।

সূত্র জানায়, সিএনজি মালিক-চালকদের কাছ থেকে এ চক্রটি ‘সিএনজি চুরি প্রতিরোধের’ নামে প্রতি মাসে সিএনজি অটোরিকশা বাবদ দুই হাজার টাকা করে আদায় করছে। এই হিসাবে মাসে আদায় করা হচ্ছে এক কোটি টাকা। কেউ টাকা না দিলে চোররা সিএনজি অটোরিকশা চুরি করে হাতকাটা মামুনের কাছ দিয়ে দেয়। হাতকাটা মামুন চোরাই সিএনজি অটোরিকশাগুলো ঢাকার বাইরে পাচার করে দেয়। পরবর্তীতে এসব সিএনজি অটোরিকশা পাবনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে দেয়া হয়।

আরো এক কোটি!
শুধু তাই নয় এই চক্রটি পোস্তগোলা ব্রিজসহ আশপাশের ৩টি রুট থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন অন্য খাতেও চাঁদা তুলছে। প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে টোল বাবদ ৬০ টাকা হিসাবে দৈনিক আদায় করা হচ্ছে ৩ লাখ টাকা। মাসে এই টাকার পরিমাণ ৯০ লাখ টাকা। এছাড়া সিটি টোল নামে প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০ টাকা করে। এই হিসাবে দৈনিক আদায় হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা, মাসে ১৫ লাখ টাকা।

চুরি প্রতিরোধ ও দৈনিক টোল এবং সিটি টোল মিলিয়ে মাসে সর্বমোট আদায় করা হচ্ছে দুই কোটি ৫ লাখ টাকা।

বাবুল, লেংড়া মিলন, আক্তার, রহিম ও শাকিল তাদের গুরু কিলার মফিজের হয়ে চাঁদা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জামাই রিপন। কিলার মফিজের তথাকথিত ম্যানেজার হচ্ছে মানিক ও দাঁতভাঙা দেলোয়ার। মূলত তারাই প্রতিদিন চাঁদার টাকা সংগ্রহ করে তুলে দেয় মফিজ ও তার ভাই শামীমের হাতে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চাঁদাবাজ চক্রটি এসব রুটে চলাচলকারী প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশাতে ‘ঢাকা জেলা অটোরিকশা অটো টেম্পু, মিশুক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন শ্যামপুর, ঢাকা আঞ্চলিক কমিটি’ এই নামে একটি স্টিকার সাঁটিয়ে দেয়। যার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে এগুলো তাদের চাঁদাবাজিভুক্ত সিএনজি অটোরিকশা।

তাদেরকে চাঁদা না দিলে সিএনজি অটোরিকশা চুরিসহ চালক ও মালিকদের মারধর এবং পুলিশ দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, বিপুল পরিমাণ এই চাঁদাবাজির টাকার একটি অংশ পুলিশের পাশাপাশি যায় স্থানীয় প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার পকেটেও। তাদের ছত্রছায়ায় থাকায় চক্রটি এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা প্রকাশ্যেই নিজেদের চাঁদাবাজ বলে দাবি করে।

জানা যায়, পোস্তগোলা ব্রিজ পারাপারের জন্য সিএনজি চালিত অটোরিকশা সম্পূর্ণ টোলমুক্ত। কিন্তু তারপরও চাঁদাবাজ এই চক্রটি জোরপূর্বক সিএনজি অটোরিকশা থেকে টোলের নামে টাকা আদায় করছে।

কে এই কিলার মফিজ
কিলার মফিজ হিসেবে পরিচিত মফিজুল ইসলাম নিজেকে যুবলীগ ঢাকা মহানগরের (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দেন বলে জানা যায়। ২০০৯ সালে র‌্যাব-১০ এর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হিসেবে নাম উঠে মফিজের। তার বিরুদ্ধে একাধিক খুনসহ বিভিন্ন মামলা আছে রাজধানীর একাধিক থানায়।

২০১১ সালে এই মফিজ শ্যামপর থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে তার দলবল নিয়ে রাজধানীর কদমতলীর মেরাজনগরে ৭২টি বাড়ি দখল করে নেয়। পরবর্তীতে আদালতের হস্তক্ষেপে দীর্ঘ ৬ মাস পর বাড়ির মালিকরা তাদের বাড়ি ফিরে পান।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে মফিজুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। ফোনে রিং হলেও তিনি না ধরায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

মফিজুল ইসলামের ছোটভাই শ্যামপুর কদমতলী থানা অটোরিকশা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম ওরফে শামীমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জুয়েল নামে এক ব্যক্তিক তা রিসিভ করেন। তিনি নিজেকে ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দেন। জুয়েল স্বীকার করেন তার সিটি টোল হিসেবে ১০ টাকা করে আদায় করছেন। ইজারাদার সেলিম রেজার কাছ থেকে তার সাবকন্ট্রাক্ট নিয়ে এই টাকা তুলছেন। তবে সিএনজি অটোরিকশা প্রতি দৈনিক ৬০ টাকা এবং সিএনজি অটোরিকশা চুরি প্রতিরোধের নামে মাসিক ২ হাজার টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।

অন্যদিকে শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম মিয়া এ প্রসঙ্গে বাংলামেইলকে বলেন, ‘টোলের নামে আগে চাঁদা নেয়া হতো, পরে তা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এখন যে আবার নেয়া হচ্ছে তা আমার নলেজে নেই। তবে এ বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পুলিশকে ম্যানেজ করে চাঁদবাজি হচ্ছে- এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন শ্যামপুর থানার ওসি।