শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > বেপরোয়া মানুষ, অসহায় চালক

বেপরোয়া মানুষ, অসহায় চালক

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ বিমানবন্দর স্টেশনের পাশে হজক্যাম্পের ক্রসিংয়ের অদূরেই রেললাইন ঘেঁসে কতগুলো জাম্বুরা রেখে স্লিপারে মাথা পেতে ঘুমাচ্ছিলেন একজন। দেখেই বিপজ্জনক মনে হবে।

বিশ্বরোড ক্রসিং পার হলেই চোখে পড়ে- শ্যাঁওড়া বস্তিবাসীরা সকালের ঘুম ভেঙ্গে লাইনের ওপর বসে হাত-মুখ ধুইছেন কেউ কেউ। নারীরা একের পিছনে অন্যজন বসে উকুন বাছাইয়ে লেগে পড়েছেন সকাল বেলাই। রেল-লাইনের ওপর পা রেখে উদাস ভঙ্গিতে একজনকে দেখা গেলো মোবাইলফোনে কথা বলছেন- বেপরোয়া ভঙ্গি।

এসব কিছু নজরে পড়ে লালমনি এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের সামনে বসে।

বিমানবন্দর টু কমলাপুর। বাংলানিউজ টিমের চলছিলো ট্রেনের ইঞ্জিন যাত্রা। ইঞ্জিন চেপেই আপ-ডাউন চলছিলো বাংলানিউজের কর্মীদের। ট্রেনের সামনে বসে বাংলানিউজের রিপোর্টারের চোখে ধরা পড়ছিলো এসব চিত্র। যার কিছু কিছু ধরা পড়ে ক্যামেরার ফ্রেমেও।

প্রথম যাত্রা লালমনি এক্সপ্রেসে। বিমানবন্দর থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনেই বাংলানিউজের কথা কথা হয় লালমনির লোকোমেটিভ মাস্টার মিজানুর রহমানের সঙ্গে। সহাস্যে জানালেন ট্রেন দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনা এইডসের চেয়েও মারাত্মক। এইডস হলে চিকিৎসা আছে। কিন্তু ট্রেনে ধরলে সব নিয়ে নেবে। এজন্য লাইন থেকে দূরে থাকতে চাই সবার আগে সচেতনতা।

মিজান বলেন, ট্রেন তো আপনাকে দাবড়িয়ে ধরে না। সে নির্দিষ্ট লাইনে চলে। রাতজাগা ক্লান্ত মানুষটি বললেন, আমরা চালকরা বড়ই অসহায়। যখন বুঝতে পারি লোকটি কাটা পড়ছে তখন আর কিছুই করার থাকে না।

এত যে মৃত্যু দেখেন কেমন মনে হয় তখন? এমন প্রশ্নে মিজান বলেন, যা দেখি, তা দ্রুতই ভুলে যাই। তা না হলে ট্রেন চালাতে পারতাম না।

সুযোগ পেয়ে কথা বাড়তে থাকে মিজানের। বললেন, জমি রেলের, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ গডফাদারদের হাতে। স্থানীয় গডফাদাররা রেলের জমিতে বাজার বসান, বস্তি বানান। অথচ কেবল বাণিজ্যিক, ফিশারি ও কৃষিতে জমি লিজ দেয় রেল। এসব জমিতে বাজার আর বসতি গড়ে মানুষ।

ঢাকার কারওয়ানবাজারে রেল লাইনের পাশে যেভাবে মানুষ বাস করে, তেমনটা আর কোথাও দেখা যাবে না।

এরপর টিমটি উঠে পড়ে চট্টগ্রাম মেইলের ইঞ্জিনের সামনে। সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়ে চট্টগ্রাম মেইল। ৮টা ৪৩ মিনিটে বনানী, ৪৫ মিনিটে সৈনিক ক্লাব, ৪৬ মিনিটে মহাখালী, ৪৭ মিনিটে নাখালপাড়া বাজার, ৫০ মিনিটে কারওয়ানবাজার, ৫২ মিনিটে মগবাজার, এরপর মালিবাগ, খিলগাঁও হয়ে ৮টা ৫৭ মিনিটে কমলাপুর।

সময় মাত্র ১৭ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে কত অব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, অজ্ঞতা আর অবহেলা চোখে পড়ে তার ইয়ত্তা নেই।

কারওয়ানবাজার এলাকায় যেনো এ অব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি। রেলের লাইন ঘেঁসে সারি সারি চুলায় ধোঁয়া উঠছে। কোনোটায় ভাত ফুটছে, কোনোটায় রান্না হচ্ছে তরকারি।

ট্রেন যখন পার হয়ে যাচ্ছিলো, তখন বডির নীচে ঢাকা পড়ে যায় রান্নার হাঁড়ি। কিন্তু মানুষগুলোর নির্বিকার মুখ বলে দেয় ওগুলো নিয়ে তাদের ভাবনা নেই।

হঠাৎ চোখে পরে যেই ট্র্যাকে ট্রেন চলছে তারই কিছু দূরে কয়েকজন গোসল করছেন। পাথর ছড়ানো ইষ্পাত আর কাঠের ট্রেন লাইনে গোসল করার সুবিধা আছে। নিচে কাদা হয় না। ট্রেন এসে গেলে সরে পড়লেই হলো-এই ভাবনায় নির্বিকার গায়ে পানি ঢেলে চলছিলেন একজন। ট্রেন যখন অনেক কাছাকাছি তখনই সরে গেলেন ট্র্যাক থেকে।

ভেজা লুঙ্গিতে এই সরে যাওয়া অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। লুঙ্গি শরীরের সঙ্গে পেঁচিয়ে পড়েও যেতে পারতেন। কিন্তু বেপরোয়া মানুষগুলোর তা নিয়ে ভাবনা নেই।

সারি সারি শিশু-কিশোরদের ট্রেন লাইনের এত কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যে, তাদের প্রায় পেট ছুঁয়ে ছুটে যায় যন্ত্রদানব ট্রেন। সঙ্গে বিশাল শব্দে হুইসেল।

আগের দিনই কারওয়ানবাজারের এই বস্তির কাছে ট্র্যাকে কাটা পড়ে নিহত হয় চারজন। এতবড় দুর্ঘটনার পরও এত অসচেতনতা, নিজেদের নিরাপত্তায় এতটা অবহেলা ধারণাতীত মনে হয়।

নাখালপাড়া, মালিবাগ আর খিলগাঁওয়ে বাজার বসেছে ট্রেন লাইনের ওপরে। গাড়ির চাকা ছুয়ে যাচ্ছে লাউ-কুমড়ো আর শাকের আঁটি। মানুষের ভয় নেই। ট্রেন এলে লাফিয়ে ঝাপিয়ে সরে যাচ্ছেন ঝটপট। তবে খাঁচা ভর্তি মুরগিগুলোর কাঁপন উঠেছে । ওগুলোর ভয়ার্ত কক কক শব্দ মিইয়ে গেছে রেলদানবের কর্কশ শব্দে।

এসব নিয়ে ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় এ ট্রেনের লোকো মাস্টার বরণ চন্দ্র মালির সঙ্গে। কারওয়ানবাজারের দুর্ঘটনার কথা বলতেই চেহারা মলিন হলো বি সি মালির। জানালেন, বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনার প্রাথমিক দায় পড়েছিল তার চালিয়ে যাওয়া কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের ওপর। কিন্তু আসলে দুর্ঘটনার সঙ্গে কর্ণফুলীর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

বি সি মালি বলেন, আমি তো ভালোই চালিয়ে গেলাম। তখন তো কোনো সমস্যাই ছিল না।

তিনি বলেন, আপনি আমার পথে কেনো দাঁড়িয়ে থাকবেন। আমি তো আমার পথের বাইরে যাই না। আপনি কেন আমাকে বিপাকে ফেলেন? চাইলেই তো আমরা ট্রেন থামিয়ে দিতে পারি না।

ফিরতি যাত্রা রংপুর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনে। সকাল ৯টা ৫ মিনিটেই রংপুরের উদ্দেশ্যে ট্রেন ছাড়লেন লোকো মাস্টার আনোয়ার হোসেন মোল্লা। ৯টা ১৫ মিনিটে এফডিসি ক্রসিংয়ে চোখে পড়লো উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে রেলওয়ে। আগের দিনে চার প্রাণের বিনিময়ে একটি উচ্ছেদ অভিযান পাওয়া গেলো।

অভিযানের কারণেই ধীরে চলছে রংপুর এক্সপ্রেস। চোখে পড়লো একটু আগে যে সারি সারি চুলায় রান্না চলছিলো সেগুলো ভাঙ্গা হচ্ছে। দুই ধারে মানুষের ভীড়। ক্রসিং
ক্রসিংগুলোতেও দেখা যায় বাড়তি নজরদারি।

৩৫ মিনিটেই কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছে যায় রংপুর এক্সপ্রেস।

লোকো মাস্টার আনোয়ার হোসেনের ভাষায়, লাইনের দুই পাশের মানুষগুলো বড়ই কেয়ারলেস। তারা হুইসেল বাজালেও পাত্তা দেন না। আমাদের তো থামানোর সুযোগ নেই।

ওরা কেয়ারলেস কিন্তু ওদের রেল লাইনের এত কাছাকাছি কেনো আসতে দেওয়া হচ্ছে সে প্রশ্নও আনোয়ার হোসেনেরই।

তার মতে, যেকোনো মূল্যেই রেললাইন ঘেঁসা বস্তি ও বাজারগুলো তুলে দেওয়া জরুরি ওই কেয়ারলেসদের বাঁচানোর জন্যই।

বেলা সাড়ে ১০টার দিকে নজরে পড়ে বিমানবন্দর প্ল্যাটফর্ম এলাকায়ও উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। হজ ক্যাম্পের সামনের বাজার ও ক্রসিং উচ্ছেদ করছে রেলপুলিশ।

সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনে চেপে যাত্রা শুরু। একেবারেই সামনে পা ঝুলিয়ে। পথে উচ্ছেদ অভিযান চলছে বলে একটু পরপরই হুইসেল বাজাচ্ছিলেন চালক। এতে কান ঝালাপালা।

চোখে পড়লো লাইনের দুইপাশেই চলছে অভিযান। গৃহহারা, ব্যবসাহারা মানুষগুলোর চিৎকার চেঁচামেচিও শোনা গেলো পথে পথে। এ ট্রেনের লোকো মাস্টারেরও ৩৫ মিনিট লাগলো কমলাপুরে পৌঁছাতে।

পুরো পথের দুধারের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হলো। লোকো মাস্টার তার পরিচয় না জানিয়ে বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলের অসৎ কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা আর স্থানীয় গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই, বলেন তিনি।

বেলা ১২টা ৫ মিনিটে কমলাপুরের ৩ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়লো সিলেটগামী জয়ন্তিকা। এবারও সেই ট্রেনের সামনে ইঞ্জিনে বাংলানিউজ টিম। চালক আপত্তি জানালেন, সামনে থাকা যাবে না। ছুটে এলেন সাদা পোশাকধারী গার্ড।

পরিচয় জেনে বললেন, কারওয়ানবাজারে হাজার হাজার মানুষ রাস্তা বন্ধ করেছে। তারা পাথর ছুঁড়তে পারে। সেই ঝুঁকি নিয়েই ইঞ্জিনের সামনে বসে আবারও ছুটলো বাংলানিউজ টিম।

মালিবাগ পার হতেই গতি কমতে থাকলো জয়ন্তিকার। মগবাজার পার হয়ে থেমে গেলো ট্রেনটি। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা টানা ৩৭ মিনিট। এরপরে হাজার হাজার মানুষের চিৎকার আর হই-হল্লার মধ্যে কারওয়ানবাজার পার হলো জয়ন্তিকা।

দেড় ঘণ্টায় কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনের কাছাকাছি যখন জয়ন্তিকা তখন চোখে পড়লো- একটু আগে উচ্ছেদ হওয়া হজক্যাম্পের সামনের দোকানগুলো আবার বসতে শুরু করেছে! বাংলানিউজ