শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > জাতীয় > বেপরোয়া অপরাধীরা বাড়ছে খুন ধর্ষণ

বেপরোয়া অপরাধীরা বাড়ছে খুন ধর্ষণ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
অপরাধীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। বাড়ছে খুন ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ। গত রবিবার পুলিশ সদর দপ্তরের ত্রৈমাসিক অপরাধ বিষয়ক বৈঠকেও ধর্ষণও খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে মামলার সংখ্যা বেড়েছে বলে আলোচনা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ছয় মাসে ২৮০ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ জন ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া ৩৯ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। রাজধানীর বাড্ডায় সাড়ে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। গাজীপুর থেকে ছেলের গলা কাটা ও বাবার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বগুড়ায় এক তরুণীকে ধর্ষণের পর ওই ধর্ষিতা ও তার মায়ের মাথা নেড়া করে দিয়েছে ধর্ষণকারীরা। এর আগে চট্রগ্রামে এক শিশুকে দুইজনে মিলে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। দেশে শিশু ধর্ষণসহ অন্যান্য যৌন সহিংসতার সংখ্যা বাড়ছে। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার সংখ্যাও বেড়েছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং পুলিশ সুত্রে জানা গেছে।

এ বছরের এপ্রিল মে ও জুন এই তিন মাসে খুন, ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতন এবং ডাকাতি মামলা বেড়েছে বলে পুলিশের ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি তুলে ধরেন। জঙ্গি হামলা, অপহরণ, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, অস্ত্র, মাদকদ্রব্য, চোরাচালান দ্রব্য, অস্ত্র ও বিষ্ফোরক উদ্ধার, সড়ক দুর্ঘটনা, গাড়ি চুরিসহ দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় সভায়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে সারা দেশে ৫৪ হাজার ৭৩১টি মামলা হয়েছে, যা গত জানুয়ারি-মার্চের তুলনায় প্রায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। পুলিশি অভিযান ও তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে উদ্ধারজনিত মামলা বেড়েছে বলে জানানো হয় সভায়।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ১৬০ টি, ফেব্রুয়ারি মাসে এক হাজার ১৭১টি, মার্চ মাসে এক হাজার ৪৭৭টি, এপ্রিলে এক হাজার ৩৮৬টি, মে মাসে এক হাজার ৭১৯টি এবং জুন মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৪২১টি।

রাজধানীর বনানীতে গত ৫ জুলাই জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে তরুণীকে বাসায় ডেকে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাহাউদ্দীন ইভান নামের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

গত ৭ জুলাই সাভারের সোবহানবাগে ডিবি পুলিশ অফিসের ৫০ গজ সামনে একটি কলেজের অফিস কক্ষে এক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। ৯ জুলাই নোয়াখালীতে বসতঘরে ঢুকে এক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। তরুণীর আর্তচিৎকারে প্রতিবেশীরা এসে ধর্ষক মাহফুজকে গণপিটুনি দেয়। ময়মনসিংহের নান্দাইলে এক স্কুলছাত্রীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে পাটক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করেছে একই এলাকার ইব্রাহীম নামে এক যুবক। গত বৃহস্পতিবার রাতে ১০ম শ্রেণীর ওই ছাত্রীকে বাসা থেকে তুলে পার্শ্ববর্তী পাটক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৮৬। বছরটিতে ধর্ষণের চেষ্টাসহ মোট ৯১ জন এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮৭। ২০১৩ সালে ধর্ষণের পর হত্যাসহ সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৮৩। ২০১৪ সালে শুধু গণধর্ষণেরই শিকার হয় ২২টি শিশু। সব মিলে সংখ্যাটি ছিল ২২৭।

গত ১৫ বছরে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি সেবাকেন্দ্রে আসা নারী ও শিশুর সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশু। তাদের ৮০ শতাংশই ধর্ষণের শিকার। বাকি শিশুরা গৃহকর্মী হিসেবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট আটি জুলাই মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে।

এই আটটি কেন্দ্রে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) নামে পরিচিত। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের এখানে আইনি সুবিধাসহ সমন্বিত সেবা দেওয়া হচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের কার্যক্রমের অধীনে ওসিসি পরিচালিত হচ্ছে।

তবে চিকিৎসাসেবার বিষয়টি নিশ্চিত হলেও মামলাগুলো ঠিকমতো নিষ্পত্তি না হওয়ায় অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ধর্ষণের শিকার শিশুর পরিবার প্রাথমিক পর্যায়ে মামলা করতে উৎসাহী হয়। কিন্তু ওসিসি থেকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি যাওয়ার পর পারিবারিক ও সামাজিক চাপে মামলা চালানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায়। বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবার ধর্ষকের পরিবারের সঙ্গে টাকাপয়সার বিনিময়ে আপসরফা করে ফেলে।
গতকাল সোমবার সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোগড়া বাইপাস সংলগ্ন পেয়ারা বাগান এলাকার আবুল হোসেনের বাড়ি থেকে রাশেদুল (৪০) ও তার ছেলে সাইদী হাসানের (৬) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর থানার বড় হযরতপুর গ্রামে। রাশেদুল গাজীপুরে ভাড়া থেকে ভ্যান চালাতেন।

এদিকে বাড্ডা থানার এএসআই কাউসার আহমেদ বলেন, গত রোববার রাতে আদর্শনগর এলাকার একটি টিনশেড ঘরের পাশে টয়লেট থেকে অচেতন অবস্থায় ধর্ষিতা শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থলের পাশেই একটি ঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুটি থাকত। তাকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে। মেয়েটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে জানিয়ে এএসআই কাউসার বলেন, তার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। তিন বছর বয়সী শিশুটির বাবা পেশায় একজন গাড়ি চালক। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তাদের প্রতিবেশী মো. শীপনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে বাড্ডা থানার ওসি এম এ জলিল জানান।
রাজধানীর কদমতলী এলাকায় ধর্ষণের পর ২ নারীকে খুনের পৃথক মামলায় ৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কদমতলী থানার পুলিশ গত বুধবার রাতে ওই ৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে।

১৩ জুন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্রগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানা এলাকায় এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে ধর্ষণকারীরা। সালমাকে প্রলোভন দেখিয়ে নঈমিয়া ভবনের তিনতলায় পরিত্যক্ত
জায়গায় নিয়ে যায় জীবন। সেখানে আগে থেকে ছিল ইমন। নির্জন ওই স্থানে প্রথমে জীবন সালমাকে ধর্ষণ করে। এরপর ইমন তাকে দ্বিতীয় দফা ধর্ষণ করে। ধর্ষকদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সালমা কাঁদতে কাঁদতে বিষয়টি তার বাবা ও মামাকে জানিয়ে দেবে বলে জীবন ও ইমনকে জানায়। ধর্ষণের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তারা সালমার মাথার হিজাব গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। স্থাানীয় একটি মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সালমার বয়স ৯ বছর বলে মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে কিছুদিন আগে রাজধানীর বাড্ডায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। একটি ঘরে আটকে রেখে পর পর দুদিন তার ওপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়। পুলিশ দুই ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ২৯ ও ৩০ মে পরপর দুদিন ময়নারবাগের একটি ঘরে শিশুটিকে আটকে রাখা হয়। ওই এলাকার নিরাপত্তা প্রহরী ও তার এক সহযোগী এ কাজ করে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, শুধু ২০১৬ ও ১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৯৭৬টি শিশু। আর জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৩৪৭টি শিশু। এর মধ্যে শুধু গণধর্ষণের শিকার ছিল ৬১টি শিশু। ৩৪৭টি শিশুর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ৬ মাসে ৩৭১ জন ধর্ষিতার মধ্যে মেয়ে শিশু রয়েছে ২৬৩ জন, ১০৫ জন নারী এবং বাকি তিনজনের বয়স জানা যায়নি। ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৩৬ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দু’জন নারী ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন। ২৬৩ শিশুর মধ্যে আটজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৫৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দু’জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এই সময়ে আরো ৪৮ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আমাদের সময়.কম