শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাসহ সুশীল সমাজের মন্তব্য > আলোচনা হতেই হবে

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাসহ সুশীল সমাজের মন্তব্য > আলোচনা হতেই হবে

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
সরকার চাইলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন আর করতে পারবে না। বিএনপিও নির্বাচনে না যাওয়ার মতো ভুল আর করবে না। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে কেন্দ্র করে এখনই আলোচনায় বসা প্রয়োজন। সরকার যতই না না বলুক শেষ পর্যন্ত আলোচনা হতেই হবে
বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই এবং আলোচনা হতেই হবে। সে উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের যেসব সিনিয়র নেতা বলছেন, কোনো আলোচনা হবে না। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। প্রথমত, এ রকম মন্তব্য করাটাই রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও গণতন্ত্রবিরোধী। দ্বিতীয়ত, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করার জন্য বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকারকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সরকার তার ইচ্ছেমতো কোনো নির্বাচন কমিশন চাপিয়ে দিতে পারবে না। অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন হতে হবে। যেহেতু সংবিধান মেনে বিএনপিসহ প্রথম সারির সব ক’টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাবে তাই আলোচনা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, নির্বাচনকালীন সরকারও গঠন করতে পারবে না। সরকার যতই না না বলুক শেষ পর্যন্ত তাদের নির্বাচনে বসতেই হবে। এমনটিই মনে করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। শনিবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এমন মন্তব্য করেন।

একই সঙ্গে আর সময়ক্ষেপণ না করে এখনই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন তারা। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুকে সামনে রেখেই আলোচনার দ্বার উন্মোচন হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভাজন দূর করতে আলোচনায় বসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এক টেবিলে বসতে পারলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব।’

দেশের আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘আমি সব সময় মনে করি আজ হোক কাল হোক আলোচনা হতেই হবে। যারা সরকারে থাকেন তাদের দায়িত্ব বেশি। তাই আলোচনার দ্বার সরকারি দলকেই উন্মোচন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুকে সামনে রেখেই আলোচনার দ্বার উন্মোচন হতে পারে।’

বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা এখনই আলোচনায় বসে ঠিক করা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন দেশবাসী মেনে নেবে না। আর করাও সম্ভব হবে না। সরকারি দলকে এ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, আলোচনার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সরকার তাদের ইচ্ছেমতো কমিশন গঠন করলে কেউ মেনে নেবে না। তিনি আরও বলেন, এটি শুধু বিএনপিরই দাবি নয়, সব রাজনৈতিক দলসহ সবার দাবি।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, ‘আলোচনায় বসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এ আলোচনা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুকে সামনে রেখে শুরু হতে পারে। কিন্তু সরকারি দল যদি মনে করে আলোচনায় না বসে আরেকটি ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন দেশবাসীর সামনে উপহার দেবে- তাহলে তা তাদের জন্যই বুমেরাং হবে।’

প্রসঙ্গত, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিশন ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরে তাদের সঙ্গে আরও একজন যুক্ত হন। সংবিধান অনুযায়ী কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর। এ হিসাবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এরই মধ্যে বলেছেন, সরকার ‘সার্চ কমিটি’র মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের চিন্তা করছে। ২০১২ সালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল। এবারও সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করে নতুন ইসি গঠন করা হবে।

আইনমন্ত্রীর এ ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, কারা আসছেন কমিশনের শীর্ষ পদে- এমন প্রশ্ন মাথায় রেখে তারা যে যার মতো করে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, শাসক দল আওয়ামী লীগ চাইলেও ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভবিষ্যতে করতে পারবে না।

তাদের মতে, বিএনপি এবং তাদের শরিকরাও নির্বাচন বর্জনের মতো ভুল দ্বিতীয়বার করবে না। এ অবস্থায় জামায়াত ছাড়া আগামী নির্বাচনে প্রথম সারির সব ক’টি দল অংশ নেবে। এক্ষেত্রে নতুন নির্বাচন কমিশনের দিকেই নজর তাদের। মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ তাদের শরিকরা ইতিমধ্যে এ ইস্যুতে আলোচনায় বসার জন্য সরকারি দলের প্রতি তাগিদ দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অন্যান্য রাজনৈতিক দলও মনে করে ইসি পুনর্গঠনের আগে আলোচনায় বসাটা জরুরি। যদিও এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের কণ্ঠে ভিন্ন সুর। দলটির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষনেতা বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসার ঘোর বিপক্ষে। প্রকাশ্য বক্তব্য ও বিবৃতিতে তারা সাফ বলছেন, বিএনপির সঙ্গে কিসের আলোচনা। কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে ইত্যাদি।

বিশেষ করে ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েই একদিন পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংলাপের পথ বিএনপিই বন্ধ করে দিয়েছে। কোকোর মৃত্যুর পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শোক জানাতে গিয়েছিলেন। তখন সেই সুযোগটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়নি। তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।’ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘বিএনপি ঘরের দরজা বন্ধ করার মধ্য দিয়ে মনের দরজা ও সংলাপের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া গণভবনে বিএনপির চেয়ারপারসনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি যদি সেদিন আসতেন, তাহলে আজকের রাজনীতি অন্যরকম হতো।’

ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের জবাব দিতে পরদিন শুক্রবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গেলে অবশ্যই সরকারকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে।’ বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গেলে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতামূলক পথ বের না করলে আগামী নির্বাচন কখনও সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না।’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, ‘আসলে যদি সত্যিকার অর্থে সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাহলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এ প্রসঙ্গে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সংলাপ চাইলে বিএনপিকে সবার আগে সুস্থধারার রাজনীতি করার প্রতিশ্র“তি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেবে, অন্যদিকে সংলাপ চাইবে- তা হয় না।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে সরকারি দলকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতেই হবে।’

মাঠের বিরোধী দল বিএনপিই শুধু নয়, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও চায় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও চান আলোচনার টেবিলে সমস্যার সমাধান। তারা মনে করেন, ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন সরকার চাইলেও করতে পারবে না। এ অবস্থায় গণতন্ত্র রক্ষা করতে চাইলে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে হবে। এর আগে আলোচনার টেবিলে বসে একটি সমঝোতার পথ বাতলাতে হবে সরকারি দলকে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এর অর্থ দেশটি জনগণের। কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়। দেশে রাজতন্ত্রও নেই। তাই স্বভাবতই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দেশের জনগণ কি চায় তা আমলে নেয়া।’ তিনি বলেন, ‘এদেশের মানুষ আর একটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেখতে চায় না। তারা চায় সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, গ্রহণযোগ্য এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।’ জিএম কাদের বলেন, ‘সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা সব সময় সংলাপের বিপক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরছেন। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত। গণতন্ত্র মানলে সরকারের উচিত সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পথচলা।’

বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘আলোচনায় না বসাটা হচ্ছে অগণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘হিলারি ও ট্রাম্প একসঙ্গে আলোচনায় বসতে পারলে আমরা কেন পারব না। আসলে আমাদের সংলাপে না বসার মানসিকতা বদলাতে হবে।’ সূত্র: যুগান্তর