স্টাফ রিপোর্টার ॥ নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসংখ্যা এক দিকে কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, অন্য দিকে তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সংখ্যা। ইতোমধ্যে উপদেষ্টার সংখ্যা এক ডজন অতিক্রম করেছে। আরো কয়েকজন উপদেষ্টা নিযুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। যাদের মন্ত্রী রাখা যাচ্ছে না, তারা ঠাঁই পাচ্ছেন উপদেষ্টার তালিকায়। উপদেষ্টারা মন্ত্রীর মতোই সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। বাংলাদেশে ইতঃপূর্বে এত বেশি উপদেষ্টা কখনো নিয়োগ পাননি। গত প্রায় পাঁচ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মাঝে ঠাণ্ডা লড়াই দেখা গেছে। উপদেষ্টাদের নিয়োগ কতটা আইনসিদ্ধ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের কাজ কী, কেন বিপুল রাষ্ট্রীয় অর্থ তাদের পেছনে ব্যয় করা হবে, তা নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনবিদেরা জানিয়েছেন, সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নামে কোনো পদের উল্লেখ নেই। তবে রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা একটি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা। সে মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবেও আছেন মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্ন সময় তার জন্য নয়জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। এরা সবাই পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। কিন্তু পুনর্গঠনের মাধ্যমে যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে, সরকারের ভাষ্য মতেই তা একান্তই নির্বাচনকালীন। নির্বাচনকালে মন্ত্রিসভা কেবল রুটিন কাজ করবে। কোনো সিদ্ধান্তমূলক কাজ তারা করতে পারবেন না। প্রশ্ন উঠেছে, যে সরকার কোনো সিদ্ধান্তমূলক কাজই করতে পারে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ১৩ জন উপদেষ্টা কেন? শপথ না নিয়েও এরা সবাই মন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা ভোগ করবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে সরকার একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি করে ফেলেছে। তারা ইতোমধ্যে যে সরকার গঠন করেছে, তা কোনোভাবেই ‘সর্বদলীয় সরকার’ নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের নামে যা গঠন করা হয়েছে, তা মূলত মহাজোট সরকারেরই একটি পরিবর্তিত রূপ। সেই সরকারেও প্রধানমন্ত্রীর আগের উপদেষ্টারা বহাল আছেন, উপরন্তু নতুন কয়েকজন যুক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক দরকষাকষির অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, নির্বাচনকালীন সরকারের নামে মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হলেও মন্ত্রী পদমর্যাদায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টারা নিজ নিজ পদে থেকেই যাচ্ছেন। সরকার গঠনের পর থেকে নানা আলোচনা-সমালোচনায় উপদেষ্টাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও শেখ হাসিনা তাদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। বরং নতুন করে এই তালিকায় যুক্ত করেছেন আরো চারজনকে। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ মহাজোট সরকার গঠনের পরদিন ৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন উপদেষ্টা হিসেবে এইচ টি ইমাম, অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে ড. মসিউর রহমান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পদে ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা পদে ড. গওহর রিজভী এবং প্রতিরা উপদেষ্টা হিসেবে তারিক আহমেদ সিদ্দিকীকে দায়িত্ব দেন। পরে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, ড. তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সম্প্রতি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রেক্ষাপটে নতুন করে আরো চারজন এই তালিকায় যুক্ত হন। এরা হলেনÑ জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু এবং সদ্যবিদায়ী দুই মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও দিলীপ বড়–য়া। অন্তর্র্বতী সরকারে বিপুলসংখ্যক উপদেষ্টার বিষয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটা মনে করছেন সেটাই করছেন। সংবিধানের ধার ধারছেন না। পার্লামেন্টের যে নিয়মকানুন ও রীতিনীতি রয়েছে, সেগুলোকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নিউ ইয়র্ক টাইমসে বলা হয়েছেÑ সব কিছুর জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ তিনি আরো বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই নির্বাচনকালীন সরকার এত বড় থাকে না। নির্বাচনকালীন সরকারের আকার হয় ১০-১২ জনের। বাংলাদেশে যে অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করা হয়েছে, তা কোনো অন্তর্র্বতী সরকার নয়। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে উপদেষ্টাদের কোনো প্রয়োজন নেই। সরকার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে যা করছে, তা হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক দরকষাকষির অংশ। তিনি আরো বলেন, সরকার দেশে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছে। যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো গুণগত উপাদান যুক্ত করতে পারেনি। এটা হচ্ছে নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো। যারা বলবে এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, তারা হয় মিথ্যা বলছেন, না হয় বোকার স্বর্গে বাস করছেন। সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, মন্ত্রীর পদমর্যাদায় যে উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সংবিধান অনুমোদিত নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে সরকারি কার্যাবলি বণ্টন বিধিমালার অধীনে প্রযুক্ত ক্ষমতা বলে প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা নিয়োগ করছেন। এ ধরনের উপদেষ্টাদের মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এ ধরনের উপদেষ্টারা কোনো ধরনের শপথের অধীন না হওয়ায় সরকারের একজন মন্ত্রীর মতো জনগণের কাছে তার কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেলÑ নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা যখন আগের মন্ত্রিসভার কলেবর ছোট করে স্বল্পসংখ্যক মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে, তখন আগের উপদেষ্টাদের বাদ না দিয়ে নতুনভাবে আরো উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে যেখানে আগের উপদেষ্টাদের বাদ দেয়া অত্যাবশ্যক ছিল, সেখানে অনাবশ্যকভাবে আরো নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টিসহ প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান পরিপন্থী এ ধরনের উপদেষ্টা নিয়োগ কখনো কাম্য হতে পারে না।