রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > বিদেশে নির্যাতন থেকে বাঁচতে নারীকর্মীদের স্বেচ্ছা কারাবরণ!

বিদেশে নির্যাতন থেকে বাঁচতে নারীকর্মীদের স্বেচ্ছা কারাবরণ!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে বিদেশ যাওয়া প্রায় ৩ লাখ নারীকর্মীর অনেকেই চরম দুর্ভোগের শিকার। প্রতিনিয়তই তারা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের অনেকেই গৃহকর্তার নির্যাতন থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় কারাগারে আশ্রয় নিচ্ছেন। নির্যাতিতদের মধ্যে বেশিরভাগই অল্পবয়সী নারী।

বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিক নিয়ে কাজ করছে— এমন কয়েকটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে এসব তথ্য।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি নারীকর্মীর কর্মসংস্থান লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এ দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়েরা। সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর কাছে বছরে গড়ে ৪ হাজার এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়ছে। আর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ‘ভীতিকর অভিজ্ঞতা’ নিয়ে দেশে ফিরে আসছে অন্তত ১ হাজারেরও বেশি নারীকর্মী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ‘প্রাণে বাঁচার’ লক্ষ্যে গত ৬ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্তত ২০০ নারীকর্মী স্বেচ্ছায় কারাগারে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে কাতারে ১৭ জন, লেবাননে ৭৬ জন রয়েছে। অবশিষ্টরা আছেন আরব আমিরাত, বাহরাইন, জর্ডানসহ অন্য দেশের কারাগারগুলোতে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের নারীকর্মীরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনসহ সম্ভ্রম হারাচ্ছেন অনেকেই। বিদেশের মাটিতে বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়ে কারাগারসহ গোপনস্থানে লুকিয়ে নিরাপদ জীবনযাপনের চেষ্টা করছেন অসংখ্য নারী। অথচ দীর্ঘদিন ধরে চলমান এসব সমস্যা সমাধানে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কেউ উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।’

এ আইনজীবীর পরামর্শ— নারী নির্যাতন হয় এমন দেশগুলোতে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন শর্ত আরোপ করে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা অভিবাসী শ্রমিক সংস্থার (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম গত বৃহস্পতিবার বর্তমানকে বলেন, ‘অন্য দেশগুলোতে মোটামুটি ভালো অবস্থা থাকলেও লেবানন ও কাতারে কর্মরত নারীকর্মীদের অধিকাংশই নির্যাতিনের শিকার হচ্ছেন। ভয়াবহ নির্যাতন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অসহায় নারীরা বাধ্য হয়ে কারাগারে আশ্রয় নিচ্ছেন।’ নারীকর্মীদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘বিদেশে কর্মরত নারীকর্মীরা শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ তাদের রক্ষায় সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপই নেই, যা অকল্পনীয়। এমনকি ১৯৯০-এর কনভেনশন এবং ২০০৬-এর পলিসি অনুযায়ী ১০ হাজার শ্রমিক অবস্থানের দেশে দূতাবাস স্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা এখনও ‘পরিকল্পনায়’ সীমাবদ্ধ।’

তবে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন বৃহস্পতিবার বর্তমানকে বলেন, ‘ফ্যাক্টরিতে কর্মরত নারীকর্মীরা ভালো থাকলেও গৃহকর্মীরা নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সরকার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে বর্তমানে ১৬টি দেশে শ্রমিক উইংয়ের সঙ্গে নতুন করে আরও ১২টি উইং খোলা হচ্ছে— যা পর্যায়ক্রমে আরও বাড়বে।’ সচিব আরও বলেন, জনশক্তি রফতানি খাত এখন সেক্টর হিসেবে রূপ পেয়েছে। এজন্য শ্রমিকদের সব সমস্যা সমাধানে সরকার এখন আরও বেশি আন্তরিক। তিনি জানান, কনভেনশন ও পলিসির সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। আর কেউ কারাগারে থাকলে তাকে উদ্ধার করতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসেবে, ১৯৯১ থেকে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ১৯ দেশে কাজ করতে গিয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ২৯০ জন নারী শ্রমিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে লেবাননে (৮১ হাজার ৭১০ জন)।

অভিযোগ আছে, বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকরা নানা সমস্যায় দূতাবাসসহ সরকারি সংস্থাগুলোতে যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায় না। উল্টো উপর্যুপরি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ১৯৯০-এর কনভেনশন এবং ২০০৬-এর পলিসি অনুযায়ী ১০ হাজার শ্রমিক অবস্থানের দেশে দূতাবাস স্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখনও লেবাননে কোনো দূতাবাস স্থাপন করা হয়নি। এখানকার নারী শ্রমিকদের তদারকিতে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। একই ধরনের সমস্যা রয়েছে অন্য বেশকটি দেশেও।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ সোসাইটির (বিপিকেএস) নির্বাহী পরিচালক হারুনুর রশীদ বর্তমানকে বলেন, ‘প্রবাসে টাকা রোজগার করতে গিয়ে নারী শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন। তাদের নির্যাতনের বর্ণনা গা শিউরে তোলে, যা মানুষের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারীদের রক্ষায় জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।’

এদিকে নির্যাতনের সত্যতা স্বীকার করে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিচালক (বহিঃগমন) আবদুল লতিফ খান বলেন, ‘প্রবাসে নারী কর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ অহরহই আসছে। অভিযোগ বিবেচনায় সেগুলো সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে পাঠানো হয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ পেয়ে দূতাবাসগুলো অনেক সময়ই নির্যাতিতদের সেভ হোমে আশ্রয় দেয়। ক্ষেত্র বিশেষে দেশেও ফেরত পাঠায়।’

ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার নারীকর্মীরা: নারীকর্মীদের অনেকেই ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে লোপা (ছদ্মনাম) রয়েছেন কাতারে। গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে বলেন, ‘গত দুদিন আগে আমি গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়েছি। এখন বাংলাদেশি এক মুদি দোকান-ব্যবসায়ীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। বাংলাদেশি দুটি সংস্থা ও আমার পরিবারের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে দ্রুত ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছি।’ কী ধরনের নির্যাতন জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রাতদিন ঘুমহীন কাটে আমার। সারাদিন বাড়ির কাজ, আর রাতে সামলাতে হয় বৃদ্ধ পিতাসহ ৩ ছেলের মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন।’

শরীয়তপুরের সখীপুর থানার পপি (ছদ্মনাম) থাকেন ওমানে। একদিন টেলিফোনে তার ভাইকে সে জানায়, ‘ভাই আমাকে বাঁচান। বাসার ম্যাডাম আমাকে ঠিকমত খেতে দেয় না। আটকে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করে। বিভিন্ন অপরাধ ধরে শাস্তি দিতে ছেলেদের কাছে পাঠিয়ে ভোগ্যপণ্য বানায়। এখান থেকে দ্রুত উদ্ধার হতে না পারলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ আমার খোলা নেই।’ বিষয়টি এক অভিভাবক মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ সোসাইটির (বিপিকেএস) কাছে লিখিত আকারে জানিয়ে পপিকে উদ্ধারের আবেদন করেন। ওই আবেদনে বলা হয়— দালালচক্র তার বোনকে হাউজম্যাট হিসেবে ওমানে চাকরি দিয়ে এই বিপদে ফেলেছে।

যশোর কোতোয়ালি থানার বাসিন্দা সাবরিনা (ছদ্মনাম)। সংসারের অভাব অনটন ঘোঁচাতে বাহরাইনে পাড়ি জমান। গিয়েই পড়েন গৃহকর্তার রোষানলে। দিনরাত খাটলেও তাকে ন্যায্য মজুরি দেয়া হয় না। মজুরি দাবি করলেই মারপিটসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। বিষয়টি বাংলাদেশ মহিলা অভিবাসী শ্রমিক সংস্থাকে জানালে তারা তাকে উদ্ধার করে।

গত মাসে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন ২৬ জন নারী। সঙ্গে দুইজনের দুটি শিশু সন্তান। তাদের পিতা নেই। তিন বছর আগে তারা দালালের মাধ্যমে কাজের সন্ধানে ভারত যায়। ভারতে গিয়ে নানা নির্যাতন সহ্য করে দুটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে দেশে ফিরে।

বছরে গড়ে ৪ হাজার অভিযোগ, ফিরে আসে এক হাজারেরও বেশি: নানা ধরনের এসব নির্যাতনের অভিযোগ প্রতিনিয়তই জমা হয় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে। এর মধ্যে রয়েছে— প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক সংস্থা (বমসা), বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংস্থা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে এক হাজারেরও বেশি নারীকর্মী ফেরত আসছে দেশে। যদিও ফেরতের প্রকৃত সংখ্যার তথ্য নেই জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কাছে।

কম বয়সীরাও পাসপোর্টে বেশি বয়স দেখাচ্ছে: প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অনুবিভাগের সাম্প্রতিক করা এক পর্যালোচনায় বলা হয়— বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রকৃত বয়সের চেয়ে বেশি বয়স দেখিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে। অথচ নিয়ম অনুয়ায়ী কাজ নিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছু নারীর ন্যূনতম বয়স ২৫ বছর হতে হবে। অন্যদিকে পাসপোর্টে ‘বেশি বয়স’ উল্লেখ থাকায় আপাত দৃষ্টিতে বিদেশ গমনেচ্ছু কোনো নারীকর্মীকে কমবয়সী মনে হলেও আইনি জটিলতার কারণে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। জটিলতা নিরসনে পাসপোর্ট অধিদফতরের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওই পর্যালোচনায়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা অভিবাসী শ্রমিক সংস্থার (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বর্তমানকে বলেন, ‘বয়স কম দেখানো একটি প্রবণতা হয়ে গেছে। আর কম বয়সী মেয়েরাই বিদেশে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

সঙ্কট নিরসনের পথ খুঁজছে সরকার: প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অনুবিভাগ সূত্র জানায়, নারী শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করার সুযোগ, ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর তথ্য সংগ্রহ ও তা ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ নারী শ্রমিক বিদেশে পাঠানো, শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, প্রয়োজনীয় চিকিত্সা সেবাসহ নানা সহায়তা বাড়ানোর ব্যাপারে জোর দেয়া হচ্ছে। যারা কাজ নিয়ে বিদেশ যাবেন, তাদের প্রকৃত বয়স নিরূপণসহ যে কোম্পানিতে কাজ করবেন তার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সরকারিভাবে নথিভুক্ত করা হবে। কোনো কর্মী প্রতারিত এবং তা প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।