শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কাঁটা তিস্তার পানি

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কাঁটা তিস্তার পানি

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ তিস্তার পানি আধাআধি হিসেবে বণ্টনের জন্য খসড়া চুক্তি হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাতে আপত্তি জানিয়ে সেই যে বেঁকে বসেছে তা থেকে সরে আসার কোন সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতেও নেই। পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অথচ তিস্তার পানি প্রবাহ বাংলাদেশে এতটাই কমে গিয়েছে যে, রংপুর অঞ্চলে কৃষক ও মৎস্যজীবীরা রীতিমতো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার অসহায়ভাবে ভারত সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতির দিকে তাকিয়ে থেকেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কোনভাবেই যে ভারত সরকার বোঝাতে পারেননি সেটা বোঝা গেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষ স্তরের আধিকারিকদের কথা থেকে। তিস্তার পানি দেয়ার বিষয়টি মমতার অগ্রাধিকারের তালিকাতেও নেই। বরং পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, উত্তরবঙ্গের কৃষিজমি এলাকাকে আরও প্রসারিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিস্তার পানি আরও বেশি করে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে চাষের কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেচমন্ত্রী দাবি করেছেন, পশ্চিমবঙ্গেই চাষের প্রয়োজনে পর্যাপ্ত পানি তিস্তা থেকে পাচ্ছে না। তিনি জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচের এলাকাকে প্রসারিত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সরকার দেড় লাখ একর কৃষিজমিকে সেচের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে তিস্তা থেকে বেশি বেশি পানি টেনে আনার প্রয়োজন হবে। আগামী বছরে যে সেচের এলাকা আরও বাড়ানো হবে সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেচমন্ত্রী তাই প্রশ্ন তুলেছেন, পশ্চিমবঙ্গেরই যেখানে আরও বেশি বেশি তিস্তার পানি প্রয়োজন সেখানে বাংলাদেশকে বেশি পানি দেয়ার প্রশ্ন উঠছে কি করে? তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিরোধিতাকে সমর্থন জানিয়ে সেচমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে বেশি পানি দেয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের কৃষকদের মরতে দিতে পারি না। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অভিন্ন নদীর পানির অর্ধেক যে বাংলাদেশের পাওয়ার অধিকার রয়েছে সে সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নির্বিকার। ফলে তিস্তার ঐতিহাসিক প্রবাহ যেভাবে বাংলাদেশে কমতে কমতে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে তাতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সরকার। সেই উদ্বেগের কথা ধরা পড়েছে কলকাতায় গঙ্গাচুক্তি নিয়ে ৫৭তম ভারত বাংলাদেশ যৌথ কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে আসা বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা সাজ্জাদ হোসেনের কথায়। তিনি বৈঠকে এই উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। জানিয়েছেন, আগে বাংলাদেশ যেখানে তিস্তা থেকে ৫০০০ কিউসেক পানি পেয়েছে বর্তমানে তা ৫০০ কিউসেকে নেমে এসেছে। তিস্তার প্রবাহ থেকে পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ফলেই যে এটা হচ্ছে সে কথাও তিনি জানিয়েছেন। আর সে কথারই সমর্থন মিলেছে পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রীর কথাতেও। এদিকে গঙ্গা নিয়ে বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা থেকে পানি পাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশ শুকনো মওসুমে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরির পক্ষে বৈঠকে সওয়াল করেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, তিস্তার পানি বণ্টন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিক্ত ইস্যু হয়েই রয়ে যাবে। সমান পানি বণ্টনের জন্য তিস্তা চুক্তির যে খসড়া করা হয়েছে তার বিরোধিতা করছেন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন কাঁটা হয়ে উঠেছে এই তিস্তা চুক্তি। খসড়া চুক্তিতে সমান পানি বণ্টনের কথা বলা হলেও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষিকাজের জন্য আরও বেশি পানি চাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ নদী থেকে পানির প্রবাহ পরিবর্তন করে উত্তরবঙ্গে সেচকাজের জন্য ফিডার ক্যানালের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে পানি। এতে বাংলাদেশে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে গেছে। কমে তা ‘ঐতিহাসিক সর্বনিম্ন’ প্রবাহ শতকরা ১০ ভাগে দাঁড়িয়েছে। এতে তীব্র অসন্তোষ বেড়েছে বাংলাদেশের কৃষক ও জেলেদের মধ্যে। গঙ্গা চুক্তি নিয়ে দু’দেশের যৌথ কমিশনের ৫৭তম বৈঠকে যোগ দিতে ভারতে রয়েছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাজ্জাদ হোসেন। তিনি মঙ্গলবার টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, যমুনার সঙ্গে তিস্তা মিলিত হওয়ার আগে তা প্রবাহিত হয়েছে রংপুরের ভিতর দিয়ে। সেই রংপুরের কৃষক ও জেলেরা প্রশাসনকে অচল করে দিয়েছেন। রংপুরে এ নদীতে ৫০০০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হওয়ার রেকর্ড আছে। কিন্তু এর পরিবর্তে এখন প্রবাহিত হচ্ছে মাত্র ৫০০ কিউসেক পানি। এতে কৃষক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে। জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তারা ক্ষোভ দেখাচ্ছে। এতে সেখানে প্রশাসন অচল হয়ে পড়েছে। গতকাল যৌথ কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে দ্বিতীয় দিনের মতো। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল এ ইস্যুটি তুলে ধরবেন বলে জানানো হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সেচ বিষয়ক মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তাদেরও নিজস্ব বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমাদের সেচকাজে যে পরিমাণ সেচ প্রয়োজন সে পরিমাণ পানি তিস্তায় প্রবাহিত হচ্ছে না। আমরা কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চাই উত্তরবঙ্গে। সে জন্য সেখানে সেচ কার্যক্রম বাড়াতে হবে। আমরা ১.৫ লাখ একর কৃষিজমি সেচের আওতায় এনে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চাই। আগামী বছর তা বাড়ানো হবে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তিস্তা থেকে আরও বেশি পানি প্রয়োজন হবে আমাদের। আমরা নিজেদের প্রয়োজন না মিটিয়ে কিভাবে আরও পানি দেবো বাংলাদেশকে? এ জন্যই আমরা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করছি। এ চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ আরও কম পানি পাবে। আমরা তো আমাদের কৃষকদের দুর্ভোগে ফেলতে পারি না। তবে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তিস্তা চুক্তির অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ এ নদীর সম পানির ভাগ পাবে না। নদীর নিম্নাঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অধিকার আছে এবং এ অধিকারের কথা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনগুলোতে বলা আছে। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের এক সদস্য এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী নিম্নাঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবে তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য নদনদী, যা বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার পানির প্রবাহে সমান অধিকারী বাংলাদেশ। ভারতের পানি সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সে মত করেই তিস্তা চুক্তির খসড়া করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ সন্তুষ্ট। পশ্চিমবঙ্গ এখন তিস্তা থেকে যে পরিমাণ পানি নেয় ওই চুক্তির অধীনে তারা তা নিতে পারে না। এ জন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করছে। ওদিকে মঙ্গলবার প্রথম দফা বৈঠক হয়েছে। তাতে ফারাক্কা ও বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় গঙ্গায় কি পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে সে সম্পর্কিত ডাটা পর্যালোচনা করা হয়। ফারাক্কা ব্যারেজ প্রজেক্টের জেনারেল ম্যানেজার সৌমিত্র কুমার হালদার ভারতীয় পক্ষে প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, এ বছর গঙ্গায় যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে তা সন্তোষজনক। বাংলাদেশে এ নদী দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে তা নিয়ে বাংলাদেশের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত খরা মওসুমে গঙ্গায় পানির প্রবাহ বাড়াতে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। নেপালের সপ্তকোষীতে ইন্দো-নেপাল ব্যারেজ প্রজেক্টে জড়িত হতে চায় বাংলাদেশ। ওই ব্যারেজে যে পরিমাণ পানি মজুত করে রাখা হবে তা খরা মওসুমে গঙ্গায় ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এতে তিনটি দেশই উপকৃত হবে।