বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো দ্রুত নিরসন করে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি ও সহযোগিতার দিকে দৃষ্টি দিতে চায় মোদি সরকার।
এ লক্ষ্যে সীমান্ত চুক্তির পর নরেন্দ্র মোদি আসন্ন ঢাকা সফরে তিস্তা ও ট্রানজিট বা আঞ্চলিক কানেকটিভিটির জটিলতাও কাটাতে চান। আপাতত বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে কানেকটিভিটি ও সহযোগিতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে চায় দেশটি।একাধিক কূটনীতিক সূত্র এ মতামত দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরের প্রস্তুতি নিয়ে বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক, প্রধানমন্ত্রীর চিফ অব প্রটোকল আসাদ আলম সিয়াম প্রমুখ।
বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক জানান, নরেন্দ্র মোদির সফরসূচি নিয়ে এখনো কিছু ঠিক হয়নি। তার সফরসূচি চূড়ান্ত হওয়া মাত্রই জানানো হবে। তবে আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ রমজান মাস শুরুর আগেই ঢাকা সফরে আসতে পারেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরসূচি ৬ ও ৭ জুন করার জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত সীমান্ত চুক্তি বিল গত বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভায় পাসের পর এবার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে মোদি সরকার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। দুদেশের মধ্যে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি নিয়েও উদ্যোগী হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিসহ অভ্যন্তরীণ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করতে সম্প্রতি তিনি পশ্চিমবঙ্গ সফর করেন। সফরকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তিস্তা চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সম্ভব হলে নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করা যায় কি না, তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আলোচনা হয়।
ঐতিহাসিক এই চুক্তির সময় মমতাকেও সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকায় দেখতে চান মোদি। মমতা যাতে তিস্তা চুক্তিতে বড় বাধা না হয়ে দাঁড়ান এ জন্য ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসনে পশ্চিমবঙ্গের দাবি অনুযায়ী ৩ হাজার ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতেও সম্মত হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরকে কংগ্রেস আমলের চেয়েও বেশি ফলপ্রসূ করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো মিটিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মোদি সরকার। বিশেষ করে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করে আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে চায় মোদি সরকার।
এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে সীমান্ত চুক্তি লোকসভায় পাস হয়েছে। এখন তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ইস্যু আর থাকবে না। এরপর আঞ্চলিক যোগাযোগ, বিশেষ করে নেপাল, ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট স্থাপনের বিষয়ে এগিয়ে যেতে পারবে মোদি সরকার। কারণ, ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তির ক্ষেত্রে সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের সময়ে এই দুটি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের পারদ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তাতে কালো মেঘে ঢাকা পড়ে। তবে বর্তমান মোদি সরকার সেই আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর থেকে কালো মেঘ অপসারণে প্রথম থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুদেশের মধ্যে ৫০ দফা ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়। তাতে উভয় দেশের সব সমস্যা একবারে তুলে আনা হয় এবং সেগুলো একবারে সমাধানের কথা বলা হয়। পরে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো নিয়ে প্যাকেজ ডিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে প্যাকেজ ডিল থেকে তিস্তা চুক্তি বাদ পড়ে। এমনকি সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল স্বাক্ষরের বিষয়টিও বাদ পড়ার তালিকায় চলে যায়। ফলে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।
অবশেষে সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। পরে সীমান্ত প্রটোকলটি স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তা চুক্তি আর হয়নি। অন্যদিকে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিট চুক্তিতেও আপত্তি জানায় বাংলাদেশ। ফলে তিস্তা ও ট্রানজিট চুক্তি ছাড়াই মনমোহনের ওই সফর একধরনের ব্যর্থতায় রূপ নেয়।
নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নরেন্দ্র মোদি আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে চান তার সরকার প্রতিবেশীদের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল। তাই এই সফরে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের চেয়েও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি কাজ করতে পারেন।
এ ছাড়া তার সফরে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির ওপর জোর দেওয়া হবে ঠিকই, কিন্তু ট্রানজিট চুক্তি করে দুদেশ কতটা লাভবান হবে, তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পণ্য পরিবহণ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে সরবরাহ অনেক ব্যয়বহুল। তার চেয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে সরবরাহ লাভজনক কি না, সেটা দেখতে হবে। আবার ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানার ভবিষ্যৎ কী হবে, বা এ জন্য অবকাঠামোও তৈরি কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।